সবিতাশ্রীকে কিছু বলতে হল না, বড় উনুনের ওপর রান্নার কড়াইয়ের পাশে চায়ের কেটলি বসিয়ে দিলেন। বললেন–তুমি যাও, কুসুমকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কজন?
–দুজন।
–মুড়ি দিও চায়ের সঙ্গে।
কিন্তু মুড়িটুড়ি ছুঁলও না কেউ। বনশ্রী দ্বিতীয়বার ঘরে আসার পর রাজু তার দিকে বারকয়েক তাকাল। তারপর প্রথম যে কথাটা বলল তা কিছু অদ্ভুত।
–একটু আগে আমাদের খুব ফাড়াগেছে। তিনটে লোক বড় মাঠে কুঞ্জকে খুন করতে চেষ্টা করেছিল। হাসিমুখে ঠাণ্ডা গলায় বলল রাজু।
বনশ্রী অবাক হয়ে বলে–সেকী!
কুঞ্জ মাঝখানে পড়ে বলে–আহাঃ, ও সব কিছু নয়। রাজু, তোর আক্কেলটা কী রে?
বনশ্রী একটু বিরক্ত হয়ে বলে কোচ্ছেন কেন কুঞ্জদা? এ অঞ্চলের ব্যাপার যখন আমাদেরও জানা দরকার। তিনটে লোক কারা?
অন্ধকারে দেখেছি নাকি? হবে কেউ। কুঞ্জ উদাসী ভাব করে বলে।
কিন্তু বনশ্রীর ধারণা হয়, কুঞ্জ একেবারে না দেখেছে এমন নয়। হাতে টর্চ আছে, অন্তত এক ঝলক হলেও দেখা সম্ভব। তা ছাড়া কুঞ্জ না চেনে হেন লোক এখানে নেই। অন্ধকারেও ঠিক ঠাহর পাবে।
বনশ্রী বলে–মারতে পারেনি তা হলে?
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে–রাজু থাকায় বেঁচে গেছি। ওকে দেখে ওরা ভড়কে যায়। তিনজনকে আশা করেনি তো। ভেবেছিল রোজকার মতো আমি আর রবি ফিরব।
–রবি কোথায়? বনশ্রী জিজ্ঞেস করে।
—রবির ওপরই প্রথম হামলা করে। সে টর্চ ফেলে দৌড়।
–আপনার লাগেটাগেনি তো!
না।
চা খেতে বৃষ্টির জোর কিছু মিয়োলো। বনশ্রী দুটো লেডিজ ছাতা এনে দিয়ে বলল–আমার আর চিরুরটা দিয়ে দিচ্ছি। আর ভিজবেন না।
কুঞ্জ উঠে দাঁড়িয়ে বলল–কী কথা বললে না তো!
–আজ থাক।
–থাকল না হয়। রেবন্ত আর শ্যামার কথা বলবে না তো?
বনশ্রী চুপ করে থাকে। কী বুঝল কুঞ্জ কে জানে, তবে কথা বাড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-চ, রাজু।
দুজনে চলে গেলে বনশ্রী ভাবতে বসে।
.
০৪.
অন্ধকার উঠোন ছপ ছপ করছে জলে। বৃষ্টির জোর কমে গিয়ে এখন ঝিরিঝিরি পড়ছে। এই গুড়ো বৃষ্টি সহজে থামে না। সেই সঙ্গে পাথুরে ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে থেকে থেকে, দমকা দিয়ে। শরীরের হাজারটা রন্ধ্রপথ দিয়ে হাড়পাঁজরে ঢুকে কাঁপ ধরাচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে রাজু আর কুঞ্জ ঘরে এসে বসেছে। এ ঘরটা বাইরের দিকে, ভিতর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটায় কুঞ্জ থাকে। ভিতর বাড়িতে তাদের সংসারটা বেশ বড়সড়। রাজু সঠিক জানে না, কুঞ্জরা ক ভাইবোন। আন্দাজ পাঁচ-ছ জন হবে। নিজের বাড়ির সঙ্গে কুঞ্জর সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। খায়, ঘুমোয় এই পর্যন্ত।
গামছায় ঘষে ঘষে পায়ের জল মুছল কুঞ্জ চৌকিতে বসে। বলল রবির বাড়িতে একটু খোঁজ নিতে হবে।
রাজু বিরক্ত হয়ে বলে-রাত বাজে নটা। তার ওপর এই ওয়েদার।
-আরে দূর। এ আবার আমাদের রাত নাকি? তুই শুয়ে পড়! আমি একটু জিরিয়ে নিয়ে বেরোব। বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাব, তোকে উঠে দরজা খুলতে হবে না।
একটি অল্পবয়সি বউ একটু আগে এসে ঘুরঘুর করে গেছে এ ঘরে। বিছানাটা টানটান করল, আলনাটা খামোকা গোছাল। ঘোমটা ছিল একটু, তবু ঢলঢলে মুখখানা দেখতে পেয়েছিল রাজু। দুখানা মস্ত চোখে কেমন একরকমের মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি। রাজুর মনটা বার বার রাডার যন্ত্রে কী একটা অস্ফুট তরঙ্গ টের পেয়েছিল তখন। সেই বউটাই এখন পিরিচে পান সুপারি দিয়ে গেল ঘরে। আজকাল রাজু যেন অনেক কিছু টের পায়। অনেক অদ্ভুত গন্ধ, স্পর্শ, তরঙ্গ। যেগুলো স্বাভাবিক মানুষ পায় না।
কুঞ্জ অন্য দিকে চেয়ে ছিল। বউটা চলে যেতেই বলল-ও হল কেষ্টর বউ। বাগনানের এক মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে। বিয়েটা দিতে অনেক ঝামেলা গেছে।
কেষ্ট কে?
কুঞ্জ উদাস স্বরে বলে–আমার মেজো ভাই। দেখেছি, মনে নেই হয়তো। অল্প বয়সেই নেশা-ফেশা করে খুব খলিফা বনে গিয়েছিল। তার ওপর এই মেয়েটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি শুরু করে। উদ্যোগী হয়ে আমিই বিয়েটা দিই। কিন্তু বাড়িতে সেই থেকে মহা অশান্তি। বউটাকে দিনরাত কথা শোনাচ্ছে, উঠতে বসতে বাপান্ত করছে।
-কেন?
–এরকমই হয়। বিয়ের নামে ছেলে বেচে মোটা টাকা আসে যে। এই কেসটায় তো সেটা হয়নি। বললে বিশ্বাস করবি না, কেষ্ট পর্যন্ত সেই কারণে আমার ওপর টা। বলে কুঞ্জ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর খুব অন্যমনস্ক ভাবে বলে–এরপর আর বিরে ঘটকালিটা করবই না ভাবছি। কয়েকটা অভিজ্ঞতা তো হল। সত্যবাবুর বাড়িতে যে মেয়েটাকে দেখলি তার বড় বোন শ্যামার বিয়ে আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও খুব গণ্ডগোল বেঁধে গেছে। আমার কপালটাই খারাপ।
রাজুর এ সব ভ্যাজর ভ্যাজর কথা ভাল লাগছিল না। সটান বিছানায় শুয়ে গায়ে মস্ত লেপটা টেনে নিয়ে চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে চোখ বুজল। বুজতেই কীর ঢলঢলে মুখখানা দেখতে পেল চোখের সামনে। কেমন স্নিগ্ধতায় ভরে গেল ভিতরটা। বড় সুন্দর মেয়ে। ও যদি আমার বউ হত।
অবশ্য এটা কোনও নতুন ভাবনা নয়। সুন্দর মেয়ে দেখলেই মনে হয়-ও যদি আমার বউ হত।
কাঠের চেয়ারে একটু কচমচ শব্দ হয়। কুঞ্জ উঠেছে, টের পায় রাজু। ওর হচ্ছে বুনো মোষের স্বভাব। যা গোঁ ধরবে তা করবেই। রবির খোঁজ কাল সকালেও নেওয়া যেত।
চোখ বুজেই রাজু বলে-কুঞ্জ, একটা কথা বলব?
বল।
–যারা মাঠের মধ্যে রবিকে ধরেছিল তাদের কাউকে তুই চিনিস না?