প্রায় নিঃশব্দে বৈদ্যুতিক ট্রেনটা এল। চলে গেল। আবার দ্বিগুণ অন্ধকারে ডুবে গেল জায়গাটা। সরেনের খেয়াল হল, গাড়িটা ডাউন লাইন দিয়ে গেল। কালর হাতটা ছিল আপ লাইনের ওপর। এ গাড়িটায় কালুর হাত কাটা যেত না।
সুরেনের গলায় এখনও রাগ। বলল, পড়ে থাক। অনেক দিন শালার খুব বাড় দেখছি। চলো, কাকভেজা হয়ে গেলাম।
গগনচাঁদ দেখল, বৃষ্টির জল পড়ায় কালু নড়াচড়া করছে। গগন তার পাশে হাটু গেড়ে বসে বলে, তুমি যাও, স্টেশনের শেডের তলায় দাঁড়াও গিয়ে। আমি আর-একটু দেখে যাচ্ছি।
মাটি খুঁড়ে বৃষ্টির ফোঁটা ঢুকে যাচ্ছে এত তোড়। কোনও মানুষই দাঁড়াতে পারে না। চামড়া ফেটে যায়। সুরেন একটা বজ্রপাতের শব্দের মধ্যে চেঁচিয়ে বলল, দেরি কোরো না।
বলে কোলকুঁজো হয়ে দৌড় মারল।
প্রচণ্ড বৃষ্টির ঝাপটায় কালুর মাথার অন্ধকার কেটে গেছে। গগনচাঁদ অন্ধকারেই তাকে ঠাহর করে বগলের তলায় হাত দিয়ে তুলে বসাল। কালু বসে ফোপাচ্ছে।
গগন কালুর মুখ দেখতে পেল না। কেবল অন্ধকারে একটা মানুষের আবছায়া। গগন বলল, ওঠ!
কালু উঠল।
অল্প দূরেই একটা না-হওয়া বাড়ি! ভাড়া বাঁধা হয়েছে। একতলার ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে, এখন দোতলা উঠছে। পিছল পথ বেয়ে কালুকে ধরে সেখানেই নিয়ে এল গগনচাঁদ।
গা মুছবার কিছু নেই। সারা গা বেয়ে জল পড়ছে। গগন গায়ের জামাটা খুলে নিংড়ে নিয়ে মাথা আর মুখ মুছল। কালু উবু হয়ে বসে বমি করছে, একবার তাকিয়ে দেখল গগন। বমি করে নিজেই উঠে গিয়ে বৃষ্টির জল হাত বাড়িয়ে কোষে ধরে মুখে-চোখে ঝাপটা দিল।
তারপর ফের মেঝেয় বসে পড়ে বলল, শরীরে কি কিছু আছে নাকি! মাল খেয়ে আর গাঁজা টেনে সব ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।
গগনচাঁদ সে কথায় কান না দিয়ে বলল, তোর রিকশা কোথায়?
সে আজ মাতু চালাচ্ছে। আমি ছুটি নিয়েছি আজকের দিনটা।
কেন?
মনে করেছিলাম আজ পাঁচশো টাকা পাব।
গগন চুপ করে থাকে। কালুটা বোকা। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে।
গগন বললে, যে ছেলেটা খুন হয়েছে সে এখানকার নয়?
কালু হাঁটুতে মুখ গুঁজে ভেজা গায়ে বসে ছিল। প্রথমটায় উত্তর দিল না।
তারপর বলল, বিড়ি-টিড়ি আছে?
আমি তো খাই না।
কালু ট্যাক হাতড়ে বলল, আমার ছিল। কিন্তু সব ভিজে ন্যাতা হয়ে গেছে।
ভেজা বিড়ি বের করে কালু অন্ধকারেই টিপে দেখল, ম্যাচিস থেকে এক কোষ জল বেরোল। সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা অস্পষ্ট খিস্তি করে কালু বলে, সুরেন শালার খুব তেল হয়েছে গগনদা, জানলে?
গগন অন্ধকারে কালুর দিকে চাইল। তেল কালুরও হয়েছে। আজকাল সকলেরই খুব তেল।
গগন বলল, ছেলেটা কি এখানকার?
কোন ছেলেটা?
যে খুন হল?
সে-সব বলতে পারব না।
কেন?
বলা বারণ।-কালু উদাস গলায় বলে।
গগনচাঁদ একটু চুপ করে থেকে একটা মিথ্যে কথা বলল, শোন একটু আগে সুরেন যখন তোকে মেরেছিল, তখন তুই অজ্ঞান হয়ে গেলি। তোর ডান হাতটা রেল লাইনের ওপর গিয়ে পড়েছিল। আর ঠিক সেই সময় গাড়ি আসছিল। আমি তোকে সরিয়ে না আনলে ঠিক তোর হাতটা চলে যেত আজ।
কালু নড়ল না। কেবল বলল, মাইরি।
তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
কালু হঠাৎ আবার উদাস হয়ে গিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে? তুমি না সরালে একটা হাত চলে যেত! তা যেত তো যেত। এক-আধটা হাত-পা গেলেই কী থাকলেই কী!
গগনচাঁদ একটা রাগ চেপে গিয়ে বলল, দুর ব্যাটা, হাতকাটা হয়ে ঘুরে বেড়াতিস তা হলে। রিকশা চালাত কে?
চালাতাম না। ভিক্ষে করে খেতাম। ভিক্ষেই ভাল, জানলে গগনদা। তোমাদের এলাকার রাস্তাঘাট যা তাতে রিকশা টানতে জান বেরিয়ে যায়। পোষায় না। শরীরেও কিছু নেই।
কথাটা বলবি না তা হলে?
কালু একটু চুপ করে থেকে বলল, পাঁচটা টাকা দাও।
গগন একটু অবাক হয়ে বলে, টাকা। টাকা কেন?
নইলে বলব না।
গগন একটু হেসে বলে, খুব টাকা চিনেছিস। কিন্তু এটা এমন কিছু খবর নয় রে। পুলিশের কাছে গেলেই জানা যায়।
তাই যাও না।
গগনেরও ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে কালুর গলাটা টিপে ধরে। সুরেন যে ওকে মেরেছে সে কথা মনে করে গগন খুশিই হল। বলল, টাকা অত সস্তা নয়।
অনেকের কাছে সস্তা।
গগন মাথা নেড়ে বলে, তা বটে। কিন্তু আমার টাকা দামি।
কালু কাধ ঝাঁকিয়ে বলে, দিয়ো না।
গগন একটু ভেবে বলে, কিন্তু যদি পুলিশকে বলে দিই?
কী বলবে?
বলব খুনটা তুই নিজের চোখে দেখেছিস।
বলো গে না, কে আটকাচ্ছে?
পুলিশ নিয়ে গিয়ে তোকে বাঁশডলা দেরে!
দিক।-কালু নির্বিকারভাবে বলে, এত ভয় দেখাচ্ছ কেন? যে মরেছে আর যে মেরেছে তাদের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক কী? যে যার নিজের ধান্দায় কেটে পড়ো তো। কেবল তখন থেকে খবর বের করার চেষ্টা করছ, তোমাদের এত খতেনে দরকার কী?
গগনচাঁদ ভেবে দেখল, সত্যিই তো। তার তো কিছু যায়-আসে না। কে কাকে খুন করেছে তাতে তার কী? সুরেন খাঁড়া এই ভরসন্ধ্যাবেলা তাকে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে না আনলে সে মড়া দেখতে আসও না। যে মরল সে বিষয়ে একটা কৌতূহল ভিতরে ভিতরে রয়ে গেছে। বিশেষত যখন শুনেছে যে মরা ছেলেটার শরীরটা কসরত করা। ভাল শরীরওয়ালা একটা ছেলে মরে গেছে শুনে মনটা খারাপ লাগে। কত কষ্টে এক-একটা শরীর বানাতে হয়। সেই আদরের শরীর কাটা-ছেঁড়া হয়ে যাবে! ভাবতে কেমন লাগে?
বৃষ্টির তোড়টা কিছু কমেছে। কিন্তু এখনও অবিরল পড়ছে। আধখাচড়া বাড়িটার জানালা-দরজার পাল্লা বসেনি, ফাঁক-ফোকরগুলি দিয়ে জলকণা উড়ে আসছে। বাতাস বেজায়। শীত ধরিয়ে দিল। এধার-ওধার বিস্তর বালি, নুড়িপাথর ভূপহয়ে পড়ে আছে। কিছু লোহার শিকও। একটা লোক ছাতা মাথায়, টর্চ হাতে উঠে এল রাস্তা থেকে। ছাতা বন্ধ করে টর্চটা এক বার ঘুরিয়ে ফেলল গগনচাঁদের দিকে, অন্যবার কালুর দিকে। একহাতে বাজারের থলি। গলাখাঁকারি দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সে ঘরের দরজায় টিনের অস্থায়ী কঁপ লাগানো। লোকটা ঝাপের তালা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। চৌকিদার হবে।