সুরেন খাঁড়া বলে, তুই এখানে কী করছিস?
হাওয়া খাচ্ছি। কালু উদাস উত্তর দেয়।
কখন নিয়ে গেল?
একটু আগে। ঘণ্টা দুয়েক হবে।
পুলিশ কিছু বলল?–সুরেন জিজ্ঞেস করে।
ফের টচটা জ্বালতেই দেখা গেল, কালুর পা লম্বা হয়ে পাথরের স্তূপ থেকে নেমে এসেছে। ভূতের পায়ের মতো, খুব রোগা পা। আর পায়ের পাতার কাছেই একটা দিশি মদের বোতল আর শালপাতার ঠোঙা।
কালু একটু নড়ে উঠে বলে, পুলিশ কিছু বলেনি। পুলিশ কখনও কিছু বলে না। কিন্তু আমি সব জানি।
কী জানিস?
কালু মাতাল গলায় একটু হেসে বলে, সব জানি।
সুরেন খাঁড়া একটু হেসে বলে, হাওয়া খাচ্ছিস, না আর কিছু?
কালু তেমনি নির্বিকার ভাবে বলে, যা পাই খেয়ে দিই। পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেই আরাম। জায়গাটা ভরাট রাখা নিয়ে হচ্ছে কথা।
ই, মস্ত ফিলজফার!
কালু ফের মাতাল গলায় হাসে।
পুলিশকে তুই কিছু বলেছিস?–সুরেন জিজ্ঞেস করে।
না। আমাকে কিছু তো জিজ্ঞেস করেনি। বলতে যাব কোন দুঃখে?
জিজ্ঞেস করলে কী বলতিস?
কী জানি?
শালা মাতাল!– সরেন বলে।
মাথা নেড়ে কালু বলে, জাতে মাতাল হলে কী হয়, তালে ঠিক আছে সব। সব জানি।
ছেলেটা কে জানিস?
আগে জানতাম না। একটু আগে জানতে পারলাম।
কে?
বলব কেন? যে ছেলেটাকে খুন করেছে তাকেও জানি।
খুন!- একটু অবাক হয় সুরেন, খুন কী রে? সবাই বলছে রাতে ট্রেনের ধাক্কায় মরেছে!
মাথা নেড়ে কালু বলে, সন্ধের আগে এইখানে খুন হয়। আমি নিজে চোখে দেখেছি। মাথায় প্রথমে ডান্ডা মারে, তখন ছেলেটা পড়ে যায়। তারপর গলায় কাপড় জড়িয়ে গলা টিপে মারে। আমি দেখেছি।
কে মারল?
বলব কেন? পাঁচশো টাকা পেলে বলব।
পুলিশ যখন ধরে নিয়ে গিয়ে পেঁদিয়ে কথা বার করবে তখন কী করবি?
বলব না। যে খুন করেছে সে পাঁচশো টাকা দেয় তো কিছুতেই বলব না।
ঠিক জানিস তুই?
জানাজানি কী! দেখেছি।
বলবি না?
না।
গগনচাঁদ এতক্ষণ কথা বলেনি। এইখানে একটা মৃত্যু ঘটেছে, এই ভেবে সে অস্বস্তি বোধ করছিল। এবার থাকতে না পেরে বলল, খুনের খবর চেপে রাখিস না। তোর বিপদ হবে।
আমার বিপদ আবার কী! আমি তো কিছু করিনি। কালু বলল।
দেখেছিস তো সুরেন খাঁড়া বলে।
দেখলে কী?
দেখলে বলে দিতে হয়। খুনের খবর চাপতে নেই। সুরেন নরম সুরে বলে।
কালু একটা হাই তুলে বলে, তা হলে দেখিনি।
শালা মাতাল!–সুরেন হেসে গগনচাঁদের দিকে তাকায়।
কালু একটু কর্কশ স্বরে বলে, বারবার মাতাল বলবেন না। সব শালাই মাল টানে আপনিও টানেন।
সুরেন একটা অস্ফুট শব্দ করল। ইদানীং সে বড় একটা হাঙ্গামা-হুঁজ্জত করে না। কিন্তু এখন হঠাৎ গগনচাঁদ বাধা দেওয়ার আগেই অন্ধকারে দশাসই শরীরটা নিয়ে দুই লাফে এগিয়ে গেল। আলগা নুড়ি পাথর খসে গেল পায়ের তলায়। ঠাস করে একটা প্রচণ্ড চড়ের শব্দ হল। কাল এক বার আউ করে চেঁচিয়ে চুপ করে গেল। আলগা পাথরে পা হড়কে সুরেন পড়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে কালুকে দেখা যাচ্ছিল না তবে সে-ও পড়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছিল। এই সময়ে কাছেই একটা বাজ ফেটে পড়ল। বাতাস এল এলোমলো। বৃষ্টির ফোঁটা বড় বড় করে পড়ছে।
সুরেন টর্চটা জ্বালতে গিয়ে দেখে, আলো জ্বলছে না। একটা কাতর শব্দ আসে পাথরের ভূপের ওধার থেকে। সুরেন একটা মাঝারি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সেই শব্দটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। বলে, শালা যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!
কাতর শব্দটা থেমে যায়।
গগনচাঁদ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকারে বৃষ্টির শব্দ পায় সে। আকাশে চাঁদ বা তারা কিছুই নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। খুব দুর্যোগ আসবে। গ্যারাজঘরের অবস্থাটা কী হবে, ভাবছিল সে। বৃষ্টিতে তার বড় বিপদ।
সুরেন দাঁড়িয়ে নিজের ডান হাতের কনুইটা টিপে টিপে অনুভব করছে। বলে, শালা জোর লেগেছে। রক্ত পড়ছে।
আবার বিদ্যুৎ চমকায়। আবার। গগনচাঁদ দেখতে পায়, কাল লাইনের ধারে পড়ে আছে, তার ডান হাতটা রেল লাইনের ওপরে পাতা। মুহুর্মুহু গাড়ি যায়। যে-কোনও মুহূর্তে ওর ডান হাতটা দু ফালা করে বেরিয়ে যাবে।
ভাবতে ভাবতেই খুব ক্ষীণ হলুদ একটা আলো এসে পড়ল লাইনের ওপর। বহু দূরে অন্ধকারের কপালে টিপের মতো একটা গোল হলুদ আলো স্থির হয়ে আছে। গাড়ি আসছে।
গগনচাঁদ কিছু ধীর-স্থির। টপ করে কোনও কাজ করে ফেলতে পারে না। সময় লাগে। এমনকী ভানা-চিন্তাতেও সে বড় ধীর। কখন কী করতে হবে তা বুঝে উঠতে সময় লাগে।
তাই সে গাড়ির আলো দেখল, কালুর কথা ভাবল, কী করতে হবে তাও ভাবল! এভাবে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় কাটিয়ে সে ধীরেসুস্থে পাথরের কৃপটা পার হয়ে এল। গাড়িটা আর খুব দূরে নেই। সে নিচু হয়ে পাজাকোলা করে কালুকে সরিয়ে আনল লাইন থেকে খানিকটা দূরে। একটা পায়ে-হটা রাস্তা গেছে লাইন ঘেঁষে। এখানে ঘাসজমি কিছু পরিষ্কার। সেখানে শুইয়ে দিল। এবং টের পেল মুষলধারে বৃষ্টির তোড়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড চার দিকে। সব অস্পষ্ট। তাপদগ্ধ মাটি ভিজে এক রকম তাপ উঠেও চার দিকে অন্ধকার করে দিচ্ছে।
সুরেন খাঁড়া বলল, ওর জন্য চিন্তা করতে হবে না। চলো।
গগনচাঁদ কালুর বুক দেখল। এত বৃষ্টিতে বুকের ধুকধুকুনিটা বোঝা যায় না। নাড়ি দেখল। নাড়ি চালু আছে।
গগনচাঁদ বৃষ্টির শব্দের ওপর গলা তুলে বলল, ওস্তান নেই। এ অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।