কালুর জ্ঞান ফেরেনি। ফেরার সম্ভাবনাও খুব কম। অক্সিজেন চলছে। ওই অবস্থাতেই ডাক্তাররা তার ওপর অপারেশন চালিয়েছে। জানা গেছে তার ফুসফুস ফুটো হয়েছে, পেটের দুটো নাড়ি কাটা। বাঁচা-মরার সম্ভাবনা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ।
ছটকু পুলিশকে ঘটনাটা ফোনে জানিয়ে দিল। তারপর গগনকে নিয়ে বিকেলের দিকে সোজা আবার গাড়ি চালিয়ে সিংহীদের পোড়ো বাড়িতে।
ছটকু জানে। জেনে গেছে।
সদর দরজায় তালা ছিল, যেমন থাকে। ছটকু একটু চার দিক ঘুরে দেখল। পিছনের বাথরুমে মেথরের দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল।
নিঃশব্দে ভিতরে ঢোকে ছটকু। সঙ্গে গগন।
ভিতরে অন্ধকার জমেছে। এখানে-সেখানে কিছু পুরনো আন্যাংটো মেয়েমানুষের পাথুরে মূর্তি। শেষ রোদের কয়েকটা কাটাছেঁড়া রশ্মি পড়েছে হেথায়-হোথায়।
বেড়ালের পায়ে এগোয় ছটকু। এ ঘর থেকে সে ঘর।
অবশেষে ঘরটা খুঁজে পায় এবং চৌকাঠের বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকে।
ভিতরে সন্তু ক্ষীণ একটু ব্যথার শব্দ করে বলে, আমি বাড়ি যাব বাবা।
যাবে। সময় হলেই যাবে।
ছটকু সামান্য গলাখাকারি দেয়।
অন্ধকার ঘরে নানকের ছায়ামূর্তি ভীষণ চমকে যায়।
ছটকু ঘরে ঢোকে। মাথা নেড়ে বলে, কাজটা ভাল হয়নি নানকবাবু।
নানক অন্ধকারে চেয়ে থাকেন।
ছটকু গগনকে ডেকে বলে, তুই সস্তুকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে যা। ওকে এক্ষুনি ডাক্তার দেখানো দরকার।
গগন ঘরে ঢোকে। গরিলার মতো দুই হাতে সস্তুকে বুকে তুলে নেয়। নিজের ছাত্রদের প্রতি তার ভালবাসার সীমা নেই।
নানক কী একটু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।
গগন সন্তুকে নিয়ে চলে গেলে ছটকু পাইপ ধরায়। তারপর নানকের দিকে চেয়ে বলে, আমি সবই জানি। কালু মরেনি।
নানক কথা বললেন না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ছটকু বলল, কিছু বলবেন?
নানক খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, আমার ছেলেটা মানুষ হল না।
আমরা অনেকেই তা হইনি। কালুকে কে মারল নানকবাবু?
বদমাশ এবং পাজিদের মরাই উচিত।
কিন্তু সে কাজ আপনি নিজের হাতে করতে গেলেন কেন?
নানক আস্তে করে বললেন, সন্তুর জন্য। ভেবেছিলাম সন্তুকে চিরকাল একটা খুনের সঙ্গে জড়িয়ে রাখব। সেই ভয়ে ও ভাল হয়ে যাবে।
নিজের ছেলের স্বার্থে আর-একটা ছেলেকে মারতে হয়?
মাঝে মাঝে হয়।
ছটকু পাইপ টানল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, কালুকে টাকাটা কে দিয়েছিল?
আমি। ভেবেছিলাম, কালুকে হাত করে গগনকে ফাসাব। ওর ব্যায়ামাগারটা তুলে দেওয়া দরকার। সেখান থেকে গুন্ডা বদমাশের সৃষ্টি হচ্ছে।
ছটকু হেসে বলে, আপনি সমাজের ভাল চান, ছেলের ভাল চান, কিন্তু আপনার পদ্ধতিটা কিছু অদ্ভুত।
বোধহয়।– শান্ত স্বরেই নানক বলেন।
ছটকু আবার হেসে বলে, আর ফলির ব্যাপারটা?
জটিল নয়। ওকে যে মেরেছে সে অন্যায় করেনি।
কিন্তু কে মেরেছে?
নানককে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু গলার স্বরে ঝাঁঝ ফুটল। বললেন, আপনি কে?
আমি গগনের বন্ধু। গগনকে খুনের মামলা থেকে বাঁচাতে চাই।
অ। তা বাঁচবে। গগন খুন করেনি।
সেটা জানি। করল কে?
আমিই করিয়েছি। ফলি এ পাড়ার ছেলেদের নষ্ট করছিল। ড্রাগের নেশা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তা ছাড়া আমার প্রতিবেশী নরেশ নজুমদারের বাড়িতে থাকার সময়ে সে এক কুমারীর সর্বনাশ করে। নানক একটু থেমে বললেন, আমি সমাজের ভাল চাই। রাষ্ট্র যা করছে না তা আমাকেই করতে হবে।
ছটকু মাথা নেড়ে বলে, বুঝলাম।
বুঝলে ভাল।
ছটকু মাথা নেড়ে বলে, কিন্তু যে-সব গুন্ডাকে টাকা খাইয়ে আপনি ফলিকে মারার কাজে লাগিয়েছিলেন তারাই কি ভাল? তাদের অবস্থা কী হবে?
তারাও মরবে।
কী করে?
তারা আমার টাকা খায়। এ বাড়িতে তাদের আচ্ছা আমি মেইনটেন করি। একে একে সবাই যাবে। দুনিয়ায় খারাপ, লোচ্চা, বদমাশ একটাকেও বাঁচিয়ে রাখব না।
ছটকু নিঃশব্দে বসে রইল। মনটা দুঃখে ভরা।
বাইরে ক্ষীণ পুলিশের বুটের আওয়াজ শুনল সে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছটকু উঠে দাঁড়ায়।