আর কিছু?
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বলেন, না, কথাবার্তা বলতে বলতে ওরা বেরিয়ে গেল। তারপর আমি আর সেখানে থাকবার সাহস পাইনি।
ফলি আপনাকে কী বলতে চেয়েছিল তা আন্দাজ করতে পারেন? নিভন্ত পাইপে আবার আগুন দিয়ে ছটকু বলে।
না। আপনাদের সঙ্গে পরে আবার কথা হতে পারে। এখন আমার কাজ আছে।-বলে মহেন্দ্র উঠে পড়লেন।
ছটকু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ফলির জন্য আপনার কোনও শোক নেই?
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে বলেন, থাকার কথাও নয়। একে সে আমার ছেলে কি না তাই সন্দেহের বিষয়, তা ছাড়া অতি বদমাশ ছেলে।
১৩. সত্যুর হাতে-মুখে রক্ত
১৩.
কী হয়েছিল তা কেউ বলতে পারবে না।
সত্যুর হাতে-মুখে রক্ত চটচট করছে। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। গোঙাতে গোঙাতে সে কয়েকবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
ওদিকে কালু নট নড়নচড়ন হয়ে পড়ে আছে ঘাসের ওপর।
সিংহীদের নির্জন বাগান। এখান থেকে গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও কেউ শুনতে পায় না। সন্তু যখন শেষবার জ্ঞান ফিরে পেল তখন তার শরীর এত দুর্বল যে, বাগানটা হেঁটে পার হয়ে বাড়ি ফেরার কথা ভাবাই যায় না। চোখে সে সকছু সাদা দেখছে। বমি আসছে বুক গুলিয়ে। ওঠার ক্ষমতা নেই। হাঁফ ধরে যাচ্ছে শুধু টানার পরিশ্রমে।
হামাগুড়ি দিয়ে সে কোনওক্রমে বসে। তারপর বহু দিন বাদে তার চোখ দিয়ে হু-হুঁ করে কান্নার জল নেমে আসে।
আর সেই কান্নার আবেগে আর-এক বার সে জ্ঞান হারায়।
জ্ঞান ফেরে আবার। তাকিয়ে দেখে সে একটা ঘরে শুয়ে আছে। তার মাথা-মুখ ভেজা।
চোখ খোলার পরই সে তার বাবাকে দেখতে পেল। দাড়িওলা সেই ভয়ংকর মুখ, তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী চোখের দৃষ্টি। দয়ামায়া রসকষহীন এক মানুষ এই নানক চৌধুরী।
ঠান্ডা গলায় বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কালুকে মেরেছ?
একথার জবাব সন্তুর মাথায় আসে না। কিন্তু খুব আবছা হলেও তার মনে পড়ে, কালুকে মারবার সুযোগ সে পায়নি। ছুরি নিয়ে ধেয়ে যাওয়ার সময়ে কালুর ইটের ঘায়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তারপরও আবছা মনে পড়ে, কালু ছুটে এসে ইটটা তুলে তার মুখে মাথায় বার বার মেরেছে। তারপরও যদি সে কালুকে মেরে থাকে, তবে তা সজ্ঞানে নয়।
সন্তু বলল, মনে নেই।
নানক গম্ভীর হয়ে বলেন, কালুর পেটে আর বুকে ছুরির জখম। কাজটা ভাল করোনি।
এক ভয়ংকর আতঙ্কে সন্তু চোখ বুজল। খানিক বাদে আবার চোখ খুলল। সে শুয়ে আছে সিংহীদের বাড়িতে। এই ঘরেই একদা তাকে নীলমাধব মেরেছিল। এ বাড়িতেই সে একদিন গুন্ডা বেড়ালকে ফাঁসি দিতে এসে এক রহস্যময় অচেনা লোকের হাতে মার খায়।
সন্তু ডাকল, বাবা!
তার গলাটা কেঁপে যায়।
নানক সামান্য ঝুঁকে বলেন, কী?
এ বাড়িতে কে থাকে?
কে থাকবে?- নানক অবাক হয়ে বলেন, কেউ থাকে না।
সন্তু অত্যন্ত দুর্বল বোধ করে। তেষ্টায় গলা শুকনো। জিভে ঠোঁট চেটে নিয়ে সে বলে, কেউ থাকে। নিশ্চয়ই থাকে। একবার কে যেন এখানে আমার মাথায় পিছন থেকে লাঠি মেরেছিল।
নানক ঘটনাটা জানেন। চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, জানি না।
সন্তু তার বাবার দিকে তাকায়। বাবার পাঞ্জাবির হাতায় রক্ত লেগে আছে। দাড়ির ডগাতেও তাই। তাকে বাগান থেকে তুলে আনবার সময় বোধহয় লেগেছে। তবু সন্তু তার বাবার দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে নানা কথা উঁকি মারে।
সন্তু হঠাৎ বলল, আমি কালুকে মারিনি।
তুমি ছাড়া কে?
তা জানি না। তবে আমি নই।
নানক চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, সে কথা এখন ভাববার দরকার নেই। ঘুমোও।
আমি বাড়ি যাব।
একটু পরে। এখন তোমাকে নিতে গেলে আরও ব্লিডিং হতে পারে।
সন্তু তার বাবার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে বলে, মার কাছে যাব। আমাকে এখানে রেখেছেন কেন?
নানক গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সময়মতো এসে না-পড়লে এতক্ষণ তুমি বাগানেই পড়ে থাকতে।
সন্তু উঠবার চেষ্টা করে বলে, কালু কি এখনও বাগানেই পড়ে আছে?
নানক ঠান্ডা গলায় বলেন, ও বোধহয় বেঁচে নেই।
কিন্তু আমি ওকে মারিনি। ও একটা মার্ডার কেস-এর ভাইটাল আই-উইটনেস।
এ সব কথা সন্তু ডিটেকটিভ বই পড়ে শিখেছে। সে জানে কালু মরে গেলে ফলির খুনের কিনারা হবে না।
নানক তার বুকে হাতের চাপ দিয়ে ফের শুইয়ে দিলেন। একটু কড়া গলায় বললেন, তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। শোনো, কালুর সঙ্গে যে তোমার আদৌ দেখা হয়েছে তা আর কাউকে বলতে যেয়ো না।
কেন?
নানক বিরক্ত হয়ে বলেন, তোমার ভালর জন্যই বলছি। এইটুকু বয়সেই তুমি সব রকম অন্যায় করেছ। তুমি ইনকরিজিবল। কিন্তু তবু আমি চাই না, পুলিশ তোমাকে নিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাক।
কিন্তু কালুকে আমি মারিনি।
সেটা আমি বিশ্বাস করি না, পুলিশও করবে না। কাজেই বেয়াদবি করে লাভ নেই। যা বলছি শোনো।
সন্তু আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবাক হয়ে সে তার বাবার দিকে চেয়ে থাকে।
নানক বললেন, তুমি ছাড়া কেউ কালুকে মারেনি।
আমি নই –সন্তু গোঁ ধরে বলে।
তুমিই। আমি ভাবছি তোমাকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকা তোমার ঠিক হবে না।
সন্তু চুপ করে থাকে। কিন্তু তার মন নিপ নয়। সেখানে অনেক কথার বুদ্বুদ উঠছে। সে খুব নতুন এক রকম চোখে তার বাবার দিকে তাকায়। তারপর এত ব্যথা আর যন্ত্রণার মধ্যেও ক্ষীণ একটু হাসে।
.
গগন আর ছটকু যখন সিংহীদের বাড়িতে ঢুকল তখন বিকেল যাই-যাই। এর আগে তারা আর-একটা মস্ত কাজ সেরে এসেছে। মৃত্যুপথের যাত্রী কালুকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।