বেগম তার রক্তবর্ণ চোখে চাইল। প্রথমে কিছু বলল না। সামলাতে সময় নিল।
কিন্তু সামলে নিলেও সে। আঁচলে চোখ মুছল। অনেকক্ষণ শূন্য চোখে চেয়ে থেকে বলল, সেদিন..কবে যেন?
গগন বলল, পরশু।
বেগম গগনের দিকে স্থির চোখে চায়। তারপর একটু শিউরে উঠে বলে, সেদিন ফলি সন্ধের পর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছিল। বলল, গগনদা আমাকে মেরেছে। আপনি কি ওকে সত্যিই মেরেছিলেন?
গগন চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ। নইলে ও আমাকে মারত। ওর হাতে পিস্তল ছিল।
বেগম ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলে, জানি। ওর কাছে পিস্তল থাকত। ইদানীং ও খুব বিপদের জীবন কাটাত। আমি ওকে মানুষ করতে পারিনি, সে পাপের শাস্তি পেলাম গগবাবু।
ছটকু নরম স্বরে বলে, কিন্তু ফলির মৃত্যুর পেছনকার ঘটনাটা আমাদের দরকার।
বেগম মাথা নাড়ে, বুঝেছে।
মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলে, ফলি গগনবাবুকে মারবার জন্য প্ল্যান করেছিল। মারা মানে খুন নয়। উলটে ও নিজেই মার খায়। সন্ধেবেলা যখন আমার কাছে এল তখন ভীষণ ফুঁসছে, ও রকম রেগে যেতে ওকে আর কখনও দেখিনি।
ছটকু হঠাৎ বলে ওঠে, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করেনি সেদিন?
বেগম মুখটা নামিয়ে রেখেই বলল, হ্যাঁ। শুধু ঝগড়া নয়, আমাকেও ও মারে।
গগন অবাক হয়ে বলে, মেরেছে?
আমার ওপর ওর ভয়ংকর রাগ ছিল। যতটা ভালবাসত ততটাই ঘেন্না করত আমাকে। আমার সম্পর্কে ওর কানে কে যেন কিছু খারাপ গালগল্প বলে বিষ ঢেলেছে, সেই দিন ও আমার জবাবদিহি চায়, আমি ওকে যত শান্ত করতে চাই, ও তত রেগে ওঠে। অবশেষে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দেয়, চড়-চাপড় মারে, গালাগাল করতে থাকে। হয়তো আরও মারত, পাড়ার লোক এসে ঠেকায়। তখন ও কার ওপর যেন শোধ নেবে বলে শাসিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমি তখন এত দিশেহারা যে ওকে আটকাতে পারিনি। পারলে–
ছটকু জিজ্ঞেস করে, ঝগড়া ছাড়া আপনাদের মধ্যে আর কোনও কথাবার্তা হয়নি?
না। সেদিন গগনবাবুর কাছে মার খেয়ে ফলি রাগে বেহেড হয়ে যায়। কেবল গগনবাবুর নামই করছিল। সেই থেকেই আমার সন্দেহ হতে থাকে
ছটকু মাথা নেড়ে বলে, ভুল সন্দেহ বেগম দেবী।
বেগম ছটকুর দিকে স্থির-চোখে চেয়ে থাকে। দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তা হলে ফলিকে কে মেরেছে?
সেটা অনুমানের ব্যাপার।
ছটকু গম্ভীর মুখে বলে। তারপর পাইপ ধরায়।
অনুমানটা কী?
তার আগে বলুন এ পাড়ায় ফলি আর কার কার কাছে যেত?
আমি তা জানি না। আমার সঙ্গে তার বড় একটা দেখা হত না। তবে শুনেছি আমার জামাইবাবুর কাছ থেকে সে মাঝে মাঝে ধার করে টাকা নিত। কিন্তু বাড়িতে আসত না। গদিতে গিয়ে দেখা করত।
আর কেউ?
বেগম ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর বলে, না, আর কারও নাম কখনও বলেনি।
আচমকা ছটকু প্রশ্ন করে, আপনার স্বামী কোথায়? তিনি আসেননি?
বেগম অবাক হয়ে বলে, স্বামী? তিনি তো কাজে…মানে বাইরে গেছেন।
তিনি ফলির মৃত্যু-সংবাদ জানেন?
শুনেছেন।
বাইরে কোথায় গেছেন?
বলে যাননি।
তার কলেজের ঠিকানাটা দিতে পারেন?
বেগম একটু গম্ভীর মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তাঁকে এর মধ্যে না জড়ানোই ভাল। ওর শরীর খারাপ, তার ওপর এই ঘটনা।
ছটকু উঠে পড়ে। বলে, আপনার এই শোকে কিছু বলার নেই। শুধু অনুরোধ, গগনকে খামোকা ঝামেলায় জড়াবেন না। গগন ফলিকে মেরেছিল বটে, কিন্তু সে আত্মরক্ষার জন্য। ও খুনে নয়।
গেম একবার গগনের দিকে তাকাল। কবে সেই ভালবাসা মরে গেছে। এখন আছে শুধু কিছু সন্দেহ আর আক্রোশ।
তবু গগন বেগমের চোখে চোখ রেখে কিছু খুঁজল কি?
১২. বিশাল কলেজবাড়ি
১২.
মধ্য কলকাতার বিশাল কলেজবাড়ির ভিতরে ফলির বাবা মহেন্দ্রবাবুকে খুঁজে বের করতে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ আর খোঁজখবর করতে হল।
অবশেষে ল্যাবরেটরি থেকে বেয়ারা প্রায় ধরে আনল অ্যাপ্রন পরা বুড়ো মানুষটিকে।
বাঁ চোখের চশমার কাঁচ ফাটা, মুখে কদিনের বিজবিজে সাদা কাঁচা দাড়ি, মোটা গোঁফ ঠোঁট ঢেকে রেখেছে। ক্ষয়া ছোট চেহারা। চোখে সন্দেহের বা কৌতূহলের দৃষ্টি নেই। একটু ভিতু ভাব। পুত্রশোক অবশ্যই তাকে স্পর্শ করেনি। নিজেই প্রশ্ন করলেন, আপনারা আমাকে কেন খুঁজছেন?
এঁকে চেনেন?– বলে ছটকু গগনকে দেখিয়ে দেয়।
মহেন্দ্র গগনকে খুব ঠাহর করে দেখে বলেন, দেখেছি। ফলিকে ব্যায়াম শেখাত।
ফলি মারা গেছে, জানেন?
জানি। মহেন্দ্রর চোখে-মুখে অস্বস্তি।
আমরা ফলির বিষয়ে কিছু জানতে চাই।
জানার কিছু নেই। অতি বখাটে ছেলে ছিল। মরেছে, তা সে নিজেরই দোষে।
শেষ কবে আপনার ফলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
মহেন্দ্র ভেবে-টেবে বলেন, কবে যেন! পরশুই হবে।
কোনও কথা হয়নি?
যত দূর মনে পড়ে, ও খুব রেগেমেগে বাড়িতে এসেছিল। কোনও দিনই আমার সঙ্গে বনে না। ওর সঙ্গেও না, ওর মায়ের সঙ্গেও না। আমরা একটা অদ্ভুত পরিবার।
কোনও কথা হয়নি?
তেমন কিছু নয়। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ফলি আমার ছেলে কি না তাও আমি জানি না। ওর মায়ের চরিত্র ভাল নয়।
করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে। আশেপাশে বহু ছেলে-ছোকরার যাতায়াত। কেউ হয়তো কথাটা শুনে ফেলতে পারে ভেবে গগন বরং সিটিয়ে গেল। কিন্তু মহেন্দ্রবাবু বেশ স্বাভাবিক গলাতেই বলেন, তাই ও ছেলের জন্য আমার তেমন দুঃখ নেই।