সুরেন আমার কাছে কী চায় তাও জানিস না?
না।
এর আগেও সুরেন আমাকে একবার মেরেছে। শালা জানে না, কালু রিকশাওয়ালা হলেও মেড়া নয়। শালার দিন ঘনিয়ে এসেছে।
ও সব আমাকে বলছিস কেন?
আমার সন্দেহ হচ্ছে, কেউ সুরেনকে আমার বাড়ির পাত্তা লাগিয়েছে। নইলে আমার বাড়ি নোর কথা ওর নয়।
আমি ঠিকানা দিইনি।
কালু খুব হীন চোখে সন্তুর দিকে চেয়ে বলে, কাল তুই আমাকে ছোরা চমকেছিলি, মনে আছে?
সন্তু জবাব দেয় না। অন্য দিকে চেয়ে থাকে।
কালু বলে, আমি কিছু ভুলি না।
সে তোকে মারার জন্য নয়। ভয় দেখানোর জন্য!
কালু হাত বাড়িয়ে বলে, ছুরিটা দেখি।
কাছে নেই।
কালু এক্কেবারে আচমকা লাফিয়ে উঠে পটাং করে একটা লাথি লাগাল সন্তুর থুতনিতে। লাথিটা তেমন জোরালো হল না। কালুর শরীরে এখন আর তত তেজ বল নেই। সন্তু শালা ভাল খায়-দায়, গগনের কাছে ব্যায়াম শেখে। শক্ত জান, তবু আচমকা লাথি খেয়ে মুখ চেপে মাটি ধরে নিল।
কালু সময় নষ্ট করে না। পড়ে-থাকা সন্তুর প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে মালটা বের করে ফেলে। বিলিতি ছুরি, কল টিপলে ছ ইঞ্চি ইস্পাত বেরিয়ে আসে পটাং করে।
সন্তু যখন উঠল তখন কার হাতে ফলাটা জমে গেছে। চকচক করছে রোদে। কালু বলল, দেখ শালা, আমার জানের পরোয়া নেই। দরকার হলে আমি লাশ ফেলব। ঠিক করে বল, সুরেনকে কে আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।
দাত বসে গিয়ে সন্তুর ঠোঁট ফেটে হাঁ হয়ে আছে। অঝোর রক্ত। হাতের পিঠে ক্ষতস্থান মুছে নিজের রক্ত দেখল সত্ত্ব। তারপর খুব ঠান্ডা চোখে চাইল কালুর দিকে!
কাল কখনও ছুরি চালায়নি, সন্তু জানে। এও জানে, কালুর শরীরে কিছু নেই। তবে রোখ আছে।
হিসেব করতে কয়েক পলক সময় নিল সন্তু। গগনের কাছে সে বিস্তর পাঁচ শিখেছে।
সন্তু কী করল তা চোখে ভাল দেখতেও পেল না কালু। কিন্তু হঠাৎ টের পেল তার ছুরির হাতটা মুচড়ে ধরে সন্তু তাকে উপুড় করে ফেলেছে। পিঠে হাঁটু চেপে বসিয়ে মাথাটা ঠুকবার তাল করছে মাটিতে।
কালুর লাগে না। মারধর সে বিস্তর খেয়েছে। প্রায়ই খায়। মুহূর্তে সে হাঁটুতে ভর দিয়ে পটাং করে শরীরটা ছুঁড়ে দিল উলটোবাগে। সন্তু ছিটকে গেল।
দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। তারপর প্রচণ্ড আক্রোশে ছুটে আসে পরস্পরের দিকে। কালুর হাতে আধলা ইট, সন্তুর হাতে ছুরি।
১১. ভোরে ওঠা অভ্যাস
১১.
খুব ভোরেই উঠে পড়তে হল গগনকে। ভোরে ওঠা তার অভ্যাস, তার ওপর এখন প্রবল দুশ্চিন্তা চলছে।
বাথরুমের কাজ শেষ করে এসে যখন বাসি বিছানাটা নিজেই গোচ্ছাচ্ছে, তখন ছটকুর ঘর থেকে অ্যালার্ম বাজার শব্দ এল।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই ছটকু ফিটফাট হয়ে এসে গগনের দরজায় টোকা মেরে ডাকে, গগ, উঠেছিস?
উঠেছি।
চল।
গগনের মন ভাল নেই। সকালে উঠে শরীর রক্ষার জন্য দৌড়ানো বা ব্যায়াম করার মতো মন এখন তার নয় তবু ছটকুর আগ্রহে যেতে হল।
বড়লোকি সব ব্যাপার। ছটকু তার ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে ময়দানে এল। ঘড়িতে সোয়া চারটে। ভিকটোরিয়ার সামনে গাড়ি রেখে দুই বন্ধুতে ধীরলয়ে দীর্ঘ দৌড় শুরু করে। পাশাপাশি।
গগন টের পায়, ছটকু নেশাভাং যাই করুক এখনও ওর প্রচণ্ড দম। প্রায় মাইল দুই দৌড়ের পর বরং গগনের কিছু হাঁফ ধরেছে, কিন্তু ছটকু একদম ফিট:
বাড়িতে ফিরে ছটকু গগনকে নিয়ে গেল তার জিমনাশিয়ামে। ছোটর মধ্যে এত ভাল জিমনাশিয়াম গগন চোখেও দেখেনি। প্রত্যেকটা যন্ত্রপাতি ঝা-চকচকে নতুন আর দামি। বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনা।
ছটকু বলে, এ সব পড়েই থাকে বেশির ভাগ। আমি মাঝে মাঝে খেয়াল হলে ব্যায়াম করি।
দুজনে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা নীরবে নিখুঁত ব্যায়াম করে যায়। গগন নিজে প্রশিক্ষক, কাজেই ব্যায়ামের খুঁটিনাটি সব তার জানা। কিন্তু সেও অবাক হয়ে যায় ছটকুর নিখুঁত ব্যায়াম দেখে। কোথাও কোনও খাকতি নেই।
ব্যায়ামের পর দুজনেই গ্লাভস পরে কিছু সময় ঘুমোঘুসি করে। ছটকু খুবই ভাল লড়ে। ওর বাঁ হাতের ছোবল বিষে ভরা। গগন দুটো ভুতুড়ে ঘুসি খেয়ে গেল ছটকুর হাতে। বলল, তুই এখনও একটি বিন্দু আছিস। লড়া ছেড়ে দিলি কেন?
আরে দূর! লড়ে হবে কী?
কিন্তু এখনও তোর ঘুসিতে অনেক ব্যাপার আছে।
ছটকু গ্লাভস খুলে ফেলে উদাস মুখে বলে, কী জানিস! আসলে আমার জীবনটা তো হ্যাপি নয়। চারদিকটার ওপর আমার আক্রোশ। ঘরে একটা কালো সাপ পুষছি। কেউ আমাকে বোঝে না, আমার প্রতি কারও সিমপ্যাথি নেই। সেই সব দুঃখে, রাগ, আক্রোশ সব আমার ঘুসিতে বেরোয়।
গগন বুঝতে পারে। ছটকুর জন্য তার একটু মায়াও হয়। বড়লোকেরাও দুনিয়াতে সুখে থাকে না তা হলে!
গগনের চিন্তা ভাত কাপড় নিয়ে। অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় তার দিন ক্ষয় হয় রোজ। সে লড়াই ছটকুর নেই। তবু ভগবান ওকেও তো সুখ দেননি।
এলাহি জলখাবারের আয়োজন টেবিলে সাজানো। বেশিরভাগই ইংলিশ খানা। হ্যাম অ্যান্ড এগ, পরিজ, টোস্ট, ফল। গগন মাছ-মাংস খায় না বলে তার জন্য অনেকখানি ছানা দেওয়া হয়েছে। আর বাদামের শরবত।
গগন খুব বেশি খায় না। পেট ভার করে খাওয়া তার ভীষণ অপছন্দ। ছটকুও বেশি খেল না। সাজানো খাবারের অধিকাংশই পড়ে রইল।
ছটকু তার পাইপ ধরিয়ে বলে, তুই তো জুড়ো শিখছিলি, না?
হ্যাঁ।
আমিও শিখেছিলাম লন্ডনে।
জানি।