গগন খানিক বসে থেকে হঠাৎ বুঝতে পারল যে এবার তার কিছুকলা উচিত। ছটকুকী ভাবছে?
গগন বলে, তোর বউ ঘুমিয়েছে।
কেন?- ছটকুর মুখে দুষ্টুমির হাসি।
না, বলছিলাম কী পাশের ঘরে উনি এখন ঘুমিয়ে আছে আর আমরা কথাবার্তা বলছি, এতে ওঁর ডিসটার্ব হতে পারে।
নিভন্ত পাইপটা আবার ধরিয়ে ছটকু মৃদুস্বরে বলে, ঘুমোয়নি, একটু আগেই কথা হচ্ছিল।
গগন আড়চোখে দেখে পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। জোরালো আলো নয়, মিষ্টি একটা হলুদ আভার বাতি। শোওয়ার ঘরের দরজায় ফুটফুটে সাদা জালি পরদা ঝুলছে। ওপাশে যে মহিলা আছেন তিনি গগনকে কী চোখে দেখবেন সেইটাই সমস্যা।
গগন বলল, একটু বিপদে পড়ে তোর কাছে এসেছি।
ছটকু হেসে বলে, গগ, বিপদটা একটু নয়। একটু বিপদে পড়ে এত রাতে তুই আসিসনি।
বরাবরই ছটকু তাকে গগ বলে ডাকে। প্রথম জীবনে ছটকু তার নাম দিয়েছিল গগ্যা। গগন থেকে গগ্যাঁ, বিশ্ববিখ্যাত আঁকিয়ে গগ্যাঁর সঙ্গে নান মিলিয়ে। পরে আর-এক আর্টিস্টের নামের সঙ্গে মিলিয়ে গগ বলে ডাকত। ই ওই স্বভাব, যে অরও নাই খানিকটা পালটে বা বিকৃত করে ডাকবে।
গগন রুমালে মুখ-গলা মুছে বলল, বিপদটা কঠিন বলে মনে হয় না। তবে আমার একজন হিতৈষিণী আমাকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছে।
হিতৈষিণীটি কে?
ল্যান্ডলর্ডের বউ। নাথিং রোমানটিক।
অ। আর বিপদটা?
একটা খুনের ব্যাপার।
খুন! বলে ভ্রূ তোলে ছটকু
গগনের হাসি আসে না, তবু দাঁত দেখিয়ে গগন বলে, খুন কি না জানি না। তবে কেউ কেউ বলছে খুন। আর তাতে আমাকে ফাঁসানোর একটা চেষ্টা হয়েছে।
ছটকু কী একটা বলতে গিয়েও হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে সামলে গেল। কিছু একটা টের পেয়েছিল ছটকু। কারণ কথাটা গগন শেষ করার পরপরই শোয়ার ঘর থেকে একটি মেয়ে বাতাসে ভেসে আসবার মতো এ ঘরে এল। ভারী উদাসীন নিশব্দ আর অনায়াস হাটার ভঙ্গি;
এত সুন্দর মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। যেমন গায়ের রং, তেমনি ফিগার আর মুখখানা। এইসব মুখের জন্য দুই রাষ্ট্রে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। লম্বাটে, পুরস্ত, ধারালো সুন্দর সেই মুখশ্রী, ভারী দুখানা চোখের পাতা আধবোজ। অল্প একটু লালচে চুলের ঢল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা, পরনে একটা রোব।
ঘরে ঢুকে গগনের দিকে দু-এক পলক নিস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকে মেয়েটি। ঘরটা এক সুগন্ধে ভরে যায়।
ছটকু ওর দিকে পিছন ফিরে বসে ছিল। ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, লীনা, এ আমার বন্ধু গগন চৌধুরী।
লীনা কথা বলল না। তবে একটু কুঁচকে বলল, নাইস টাইম ফর এ ফ্রেন্ড টু কল।
ছটকু সামান্য বিরক্তির সঙ্গে বলে, লিভ ইট।
লীনা বসবার ঘরের পিছনে বড় পরদার ওপাশে আড়ালে চলে যায়।
ছটকু আবার পাইপ ধরিয়ে বলে, কী খাবি? খাব?
–গগন অবাক হয়ে বলে, খাব কী রে?
না খেয়ে থাকবি নাকি? না কি লজ্জাটজ্জা পাচ্ছিস?
বাস্তবিক গগন লজ্জা পাচ্ছিল। সঙ্গে আবার একটু ভয়ও। এইমাত্র ছটকুর বউ লীনা অ্যায়সা দারুণ অ্যাকসেন্টে ইংরিজি বুলি বেড়েছে যে তাতেই গগন থমকে গেছে, ইংরিজিটা তো মেমসাহেবের মতো বলেই, তার ওপর মেজাজও সেই পরদায় বাঁধা। তাই গগন বড় ভিতু সিতু হয়ে পড়েছে।
ছটকু একটু হাসল। বরাবর ছটকুর মাথা ক্ষুরের মতো ধারালো। টক করে অনেক কিছু বুঝে নেয়। গগনের ব্যাপারটাও বুঝে নিয়ে বলল, ঘাবড়াচ্ছিস? কিন্তু ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমার ঘর এটা, আমিই মালিক। তোর কে কী করবে?
গগন বলে, আরে দূর! ও সব নয়। আমার খিদেও নেই।
অত বড় শরীরটায় খিদে নেই কী রে? দাঁড়া, ফ্রিজে কিছু আছে কি না লীনাকে দেখতে বলছি।
এই বলেই বেশ গলা ছেড়ে দাপটে হাক দিল ছটকু, লীনা! এই লীনা–
অত্যন্ত ভয়াবহ মুখে লীনা পরদা সরিয়ে দেখা দেয়। চুলের একটা ঝাপটা তার অর্ধেক মুখ ঢেকে রেখেছে, চোখে সাপের চাহনি, মাথাটা এক বার ঝাঁকিয়ে বলে, চেঁচিয়ে কি নিজেকে অ্যালার্ট করতে চাইছ? কী বলবে বলো।
ছটকু সুখে নেই তা গগন নিজের দুঃখ-দুশ্চিন্তার মধ্যেও বুঝতে পারে। মেয়েছেলেরা অ্যায়সা হারামি হয় আজকাল!
ছটকু গম্ভীর মুখে কিন্তু ঠান্ডা গলায় বলে, গগনকে কিছু খেতে দাও।
লীনা খুব অবাক হয়ে গগনের দিকে তাকায়। এত রাতে একটা উটকো লোক এসে খেতে চাইবে এটা যেন কল্পনার বাইরে।
গগন মিন মিন করে বলল, না,না, আমার কিছু লাগবে না।
লাগবে- ছটকু ধমক দেয়।
লীনা অবাক ভাবটা সামলে নিয়ে খুব চাপা সরু গলায় বলে, তা সেটা আমাকে হুকুম করছ কেন? বেল বাজালেই সামু আসবে। তাকে বলো।
বেলটা তুমিই হয় বাজালে!
গগন না থাকলে লীনা আরও ঝামেলা করত। সেটা গগন ওর চোখের ঋজালো কটাক্ষেই বুঝল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে দেয়ালের একটা বোম একবার টিপে দিয়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
ছটকু গগনের দিকে তাকিয়ে একটু যেন জয়ের হাসি হাসে। তবে হাসিটাতে বিষ মেশানো। আবার নিভে যাওয়া পাইপ ধরায়। বলে, বেশ আছি।
গগন একটু ঘামে। এয়ারকুলার যথেষ্ট ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে তাকে জমিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবু গগন ঠান্ডা হচ্ছে না তেমন। পকেটে একগোছা নোট ভরে দিয়েছে শোভা। কেন দিয়েছে, কত দিয়েছে তা ভাববার বা দেখবার সময় পায়নি গগন। তবে দিয়েছে ঠিকই। এই টাকায় গগন বরং গিয়ে একটা হোটেলে উঠলে ভাল করত। এখানে এসে উপরি ঝামেলা পোয়াতে হত না। দুটো মানুষের লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে তখন তার ফাপর অবস্থা।