নরেশ মজুমদার এতক্ষণ নামেনি। এইবার নেমে আসতে সবাই তার চেহারা দেখে অবাক। রাস্তার বাতি, পুলিশের টর্চ আর বাড়ির আলোর জায়গাটা ফটফট করছে আলোয়। তাতে দেখা গেল নরেশ মজুমদারের চোখে-মুখে স্পষ্ট কান্নার ছাপ। চুলগুলো এলোমেলো। গায়ে জামা-গেঞ্জি কিছুই নেই পরনে একটা লুঙ্গি মাত্র।
নরেশ নেমে এসেই মদনবাবুকে হাতজোড় করে বলে, ভিতরে চলুন। আমার কিছু কথা আছে।
মদন সুরেনের দিকে ফিরে একটু চোখ টিপলেন। প্রকাশ্যে বললেন, সুরেন, তুমি তো পাড়ার মাথা, তা তুমিও না হয় চলো সঙ্গে।
নরেশ বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
সুরেন খুব ডাটের সঙ্গে বলে, নরেশবাবু কথা আপনার যা-ই থাক, বিনা প্রমাণে আপনি গগনকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ভাল কাজ করেননি। কাল সন্ধেবেলা গগন জিমনাশিয়ামে ছিল, ত্রিশ-চল্লিশ জন তার সাক্ষী আছে।
নরেশ গম্ভীরমুখে বলে, সব কথা ভিতরে গিয়েই হোক। রাস্তা-ঘাটে সকলের সামনে এ সব বলা শোভন নয়। আসুন।
নরেশের পিছু পিছু সুরেন আর মদন ভিতরে ঢোকে।
নানক চৌধুরী ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। তাকে ওরা বিশেষ গ্রাহ্য করল না। অথচ একটা অতি গুরুতর ব্যাপারের সে প্রত্যক্ষদর্শী।
ঘরের এক ধারে একটা রিভলভিং চেয়ারে বেগম আধ-শোয়া হয়ে চোখ বুজে আছে, কপালে একটা জলপট্টি লাগানো, ডান হাতের দুটো আঙুলে কপালের দুধার চেপে ধরে আছে। তার কান্না শোনা যাচ্ছে না, তবে মাঝে মাঝে হেঁচকির মতো শব্দ উঠছে।
শোভারানি ভিতরের দরজায় অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। তার দুচোখে বেড়ালের জলন্ত দৃষ্টি।
নরেশ মজুমদার যখন তার অতিথিদের এনে ঘরে ঢুকল তখন শোভারানির ঠাটে একটা হাসি একটু ঝুল খেয়েই উড়ে গেল।
বেগম এক বার রক্ত চোখ মেলে তাকায়। আবার চোখ বুজে বসে থাকে। নরেশ মজুমদার গেমের দিকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে মদনের দিকে চেয়ে বলে, ওই হল ফলির মা, আমার শালি।
মদন গভীরমুখে বলে, ও সব আমরা জানি।
নরেশ মজুমদার এ কথায় একটু হাসবার চেষ্টা করে বলে, এতক্ষণ আমি আমার শালির সঙ্গে আলোচনা করছিলাম।
মদন আর সুরেন দুটি ভারী নরম সোফায় বসে। সুরেন বলে, অনেক রাত হয়েছে নরেশবাবু, কথাবার্তা চটপট সেরে ফেলুন।
নরেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ সুরেনের দিকে চেয়ে বলে, আপনি বলছিলেন গতকাল গগন সন্ধেবেলায় জিমনাশিয়ামে ছিল। আপনি কি ঠিক জানেন ছিল?
আলবত– সুরেন ধমকে ওঠে।
সুরেশ মাথা নেড়ে বলে, না সুরেনবাবু গগন সন্ধেবেলায় জিমনাসিয়ামে ছিল না। সে সন্ধে সাতটার পব ব্যায়াম শেখাতে আসে। তারও সাক্ষী আছে।
সুরেন পা নাচিয়ে বলে, এ এলাকায় গগনকে সবাই চেনে নরেশবাবু। সে দেরি করে জিমনাশিয়ামে এলেও কিছু প্রমাণ হয় না। জিমনাশিয়ামে যাওয়ার আগে সে কোথায় ছিল সেইটাই তো আপনার জিজ্ঞাস্য? তার জবাবে বলি, যেখানেই থাক লুকিয়ে ছিল না। আপনি গগনের পিছনে লেগেছেন কেন বলুন তো?
এ কথা শুনে বেগম আবার তার রক্তরাঙা চোখ খুলে তাকাল। সোজা সুরেনের দিকে চেয়ে কান্নায় ভাঙা ও ভারী স্বরে বলল, গগনবাবু কাল সন্ধেবেলা কোথায় ছিলেন তা কি আপনার জানা। আছে?
না।
তা হলে জামাইবাবুকে আমোক চোখ রাঙাচ্ছেন কেন? যদি জানা থাকে তা হলে সেটাই বলন।
মদন কথা বলেনি এতক্ষণ, এবার বলল, ও সব কথা থাক। সাসপেক্ট কোথায় ছিল না ছিল সেটা পরে হবে। আপাতত আমি জানতে চাই আপনারা কোনও ইনফর্মেশন দিতে চান কি না, আজেবাজে খবর দিয়ে আমাদের হ্যারাস করবেন না। কংক্রিট কিছু জানা থাকলে বলুন।
নরেশ মজুমদার বলল, ফলি কি খুন হয়েছে?
মদন গম্ভীর মুখে বলে, পোস্টমর্টেমের আগে কী করে তা বলা যাবে?
খুন বলে আমাদের সন্দেহ হয় না?
আমরা সন্দেহন্দেহ করতে ভালবাসি না। প্রমাণ চাই।
কিন্তু আই-উইটনেস তো আছে।
সুরেন ফের ধমকে ওঠে, উইটনেস আবার কী? একটা বেহেড মাতাল কী বলেছে বলেছে সেটাই ধরতে হবে নাকি?
শোভারানি এতক্ষণ চুপ ছিল, এবারসাম্যসুর করেনরেশকে বলল, তোমার অত দরদ কীসের বলল তো?
তুমি ভিতরে যাও।
কেন, তোমার হুকুমে নাকি?
নরেশ রেগে গিয়ে বলে, যাবে কি না!
যাব না। আমার কথা আছে।
কী কথা?
তা পুলিশকে বলব।
মদন হাই তুলে বলল, দেখুন, এখনও কেসটা ম্যাচিওর করেনি। চিলে কান নেওয়ার বৃত্তান্ত। খুন না দুর্ঘটনা কেউ বলতে পারছে না। আপনারা কেন ব্যস্ত হচ্ছেন?
নরেশ বলল, যদি খুনটাকে দুর্ঘটনা বলে চালানোর ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে?
কিন্তু খুনের তো কিছু কংক্রিট প্রমাণ বা মোটিভ থাকবে।
নরেশ বলল, আপনারা পুলিশের কুকুর আনলেন না কেন? আনলে ঠিক
মদন হেসে উঠে বলে, কুকুরের চেয়ে মানুষ তো কিছু কম বুদ্ধি রাখে না। আপনার যা বলার বলুন না।
বেগম তার রিভলভিং চেয়ার আধপাক ঘুরিয়ে মুখোমুখি হয়ে বলে, আমাদের তেমন কিছু বলার নেই। তবে আমাদের যা সন্দেহ হচ্ছে তা আপনাদের বলে রাখলাম। আপনারা কেসটা চট করে ছেড়ে দেবেন না বা অ্যাকসিডেন্ট বলে বিশ্বাস করবেন না।
ঠিক আছে। এ ছাড়া আর কিছু বলবেন?
গগনবাবুকে আপনারা ধরতে গেলেন না?
কেন ধরব?-মদন অবাক হয়ে বলে।
ধরতেই তো এসেছিলেন।
মদন হেসে বলল, হুটহাট লোককে ধরে বেড়াই নাকি আমরা?
তা হলে কেন এসেছিলেন?
আপনার জামাইবাবু আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন, তা ছাড়া কালুও কিছু কথা আমাদের কাছে বলেছে। আমরা তাই গগনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।