সুরেন রাস্তা থেকে গোঁত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো ঢুকে এল গ্যারাজের দিকে।
বলল, কাল রাত থেকে লাশটা পড়ে আছে লাইন ধরে। এবার গন্ধ ছাড়বে।
গভীর গগন বলল, হ।
ছোকরাটা কে তা এখনও পর্যন্ত বোঝা গেল না। তুমি গিয়ে দেখে এসেছ নাকি?
না। শুনেছি।
ঘরে ঢুকে সুরেন চৌকির ওপর বসল। বলল, প্রথমে শুনেছিলাম খুন। গিয়ে দেখি তা নয়। কোনওখানে চোট-ফোট নেই। রাতের শেষ ডান গাড়িটাই টক্কর দিয়ে গেছে। কচি ছেলে, সতেরো-আঠারো হবে বয়স। বেশ ভাল পোশাক-টেশাক পরা, বড় চুল, জুলপি, গোপ সব আছে।
ছ। গগন বলল।
হামানদিস্তার প্রবল শব্দ হচ্ছে। ভাত নেমে গেল, কড়া চাপিয়ে জিরে-ফোড়ন ছেড়ে দিয়েছে গগন। সঙ্গে একটা তেজপাতা। সাঁতলানো হয়ে গেলেই মশলার গুঁড়ো আর নন দিয়ে ঝোল চাপিয়ে দেবে।
সুরেন খাঁড়ার খুব ঘাম হচ্ছে। টেরিলিনের প্যান্ট আর শার্ট পরা, খুব টাইট হয়েছে শরীরে। বুকের বোতাম খুলে দিয়ে বলল, বড় গুমোট গেছে আজ। বৃষ্টিটা যদি হয়!
হবে। গগন বলে, হলে আর তোমার কী! দোতলা হাঁকড়েছ, টঙের ওপর বসে থাকবে।
সুরেন ময়লা রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছে ফেলল, তারপর সেটা গামছার মতন ব্যবহার করতে লাগল মুখে আর হাতে। ঘষে ঘষে ঘাম মুছতে মুছতে বলে, তোমার ঘরে গরম বড় বেশি, ড্রেনের পচা গন্ধে থাক কী করে?
প্রথমে পেতাম গন্ধটা। এখন সয়ে গেছে, আর পাই না। চার সাড়ে চার বছর একটানা আছি।
তোমার ওপরতলার নরেশ মজুমদার তো আবার বাড়ি হাঁকড়াচ্ছে ঝিল রোডে। একতলা শেষ, দোতলারও ছাদ যখন-তখন ঢালাই হয়ে যাবে। এক বার ধরে পড়ো না, নীচের তলাকার একখানা। ঘর ভাড়া দিয়ে দেবে সস্তায়।
গগন ভাতের ফেন-গালা সেরে ঝোলের জল ঢেলে দিল। তারপর গামছায় হাত মুছতে মুছতে বলল, তা বললে বোধহয় দেয়। ওর বউ শোভারানি খুব পছন্দ করে কিনা আমাকে। একটু আগেও আমার গুষ্টির শ্রাদ্ধ করছিল।
একদিন উঠে গিয়ে কাপড় মারবে একটা, আর রা কাটবে না।
গগন মাথা নেড়ে বলল, ফু! একে মেয়েছেলে, তার ওপর বউ মানুষ।
বলে হাসে গগন। একটু গলা উঁচু করে, যেন ওপরতলায় জানান দেওয়ার জন্যই বলে, দিক না। একটু গালমন্দ, আমার তো বেশ মিঠে লাগে। বুঝলে হে সুরেন, আদতে ও মাগি আমাকে পছন্দ করে, তাই ঝাল ঝেড়ে সেটা জানিয়ে দেয়। মেয়েমানুষের স্বভাব জানো তো, যা বলবে তার উলটোটা ভাববে।
বলেই একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে গগন। সুরেনও ছাদের দিকে চেয়ে বসে থাকে। মুখে একটু হাসি দুজনেরই। শোভারানির অবশ্য কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। ওপরে কোনও বাচ্চা বুঝি স্কিপিং করছে, তারই ঢিপ ঢিপ শব্দ আসছে, আর মেঝেতে ঘুরন্ত দড়ির ঘষা লাগার শব্দ।
নরেশচন্দ্র বড় চতুর বাড়িঅলা। ভাড়াটে ওঠানোর দরকার পড়লেই সে অন্য কোনও বখেড়ায় না। গিয়ে বউ শোভারানিকে টুইয়ে দেয়। শোভার মুখ হল আঁস্তাকুড়। সে তখন সেই ভাড়াটের উদ্দেশে আঁস্তাকুড়ের ঢাকনা খুলে আবর্জনা ঢালতে শুরু করে। সেবাক্য যে শোনে তার কান দিয়ে তপ্ত সিসে ঢালার চেয়েও বেশি কষ্ট হয়। সে বাক্য শুনলে গতজন্মের পাপ কেটে যায় বুঝি। শোভারানি অবশ্য এমনি এমনি গাল পাড়ে না। নতুন ভাড়াটে এলেই তার ঘরদোরে আপনজনের মতো যাতায়াত শুরু করে, বাটি বাটি রান্না করা খাবার পাঠায়, দায়ে-দফায় গিয়ে বুক দিয়ে পড়ে। ওইভাবেই তাদের সংসারের হাল-চাল, গুপ্ত খবর সব বের করে আনে। কোন সংসারে না। দুটো-চারটে গোপন ব্যাপার আছে। সেই সব খবরই গুপ্ত অস্ত্রের মতো শোভার ভাঁড়ারে মজুত থাকে। দরকার মতো কিছু রং-পালিশ করে এবং আরও কিছু বানানো কথা, যোগ করে শোভা দিনরাত চেঁচায়। ভাড়াটে পালানোর পথ পায় না। গগনও শোভার দম দেখে অবাক হয়ে বলে, এ তো হামিদা বানুর চেয়ে বেশি কলজের জোর দেখতে পাই।
একমাত্র গগনেরই কিছু তেমন জানে না শোভা। না জানলেও আটকায় না। যেদিন নরেশকে ঝাঁকি দিয়েছিল গগন, সেদিন শোভারানি একনাগাড়ে ঘন্টা আষ্টেক গগনের তাবৎ পরিবারের শ্রাদ্ধ করেছিল। বেশ্যার ছেলে থেকে শুরু করে যত রকম বলা যায়। গগন গায়ে মাখেনি, তবে ক্লাবের ছেলেরা পরদিন সকালে এসে বাড়ি ঘেরাও করে। ব্রজ দত্ত নামে সবচেয়ে মারকুট্টা যে চেলা আছে। গগনের দোতলায় উঠে নরেশকে ডেকে শাসিয়ে দিয়ে যায়। মারত, কিন্তু গগন ওরকমধারা দুর্বলের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করে না বলে মারেনি। তাতে শোভারানির মুখে কুলুপ পড়ে যায়। কিন্তু রাগটা তো আর যায়নি। বিশেষত গগন তখনও ইচ্ছেমতো জল তোলে, কলে কোনও দিন জল না এলে নরেশের চাকরকে ডেকে ওপরতলা থেকে বালতি বালতি জল আনিয়ে নেয়। শোভা রাগ করে হয়তো, কিন্তু জল দিয়ে দেয়। ঝামেলা করে না।
ভেবে দেখলে গগন কিছু খারাপ নেই। কেবল ওই বর্ষাকালটাকেই যা তার ভয়।
লাশটার কথা ভাবছি, বুঝলে গগন!
কী ভাবছ?
এখনও নেয়নি। গন্ধ ছাড়বে।
নেবে’খন। সময় হলে ঠিক নেবে।
ছেলেটা এখানকার নয় বোধহয়। সারাদিনে কম করে দুচারশো তোক দেখে গেছে, কেউ চিনতে পারছে না।
এসেছিল বোধহয় অন্য কোথা থেকে। ক্যানিং ট্যানিং-এর ওদিককার হতে পারে।
সুরেন মাথা নেড়ে বলল, বেশ ভদ্রঘরের ছাপ আছে চেহারায়। কসরত করা চেহারা।
গগন একটু কৌতূহলী হয়ে বলে, ভাল শরীর?
বেশ ভাল। তৈরি।
আহা! বলে শ্বাস ছেড়ে গগন বলে, অমন শরীর নষ্ট করল?