দেখলে নানককে বেশ বয়স্ক লোক বলে মনে হয়। দাড়ি-গোঁফ থাকায় এখন তো তাকে রীতিমতো বুড়োই লাগে। কিন্তু সন্তুদি তার বড় ছেলে হয়, তা হলে তার বয়স খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। নানকের হিসেবমতো তার বয়স চল্লিশের কিছু বেশি।
রাত বারোটা নাগাদ নানক তার পশ্চিমধারের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকে পাড়ার বড়রাস্তা দেখা যায়। পাশের বাড়িটা নিচু একটা একতলা। তার পরেই নরেশের বাড়ির ভিতর দিকের উঠোন। উঠোনে আলো নেই বটে, তবে বাড়ির ভিতরকার আলোর কিছু আভা এসে উঠোনে পড়েছে। লোকজন কাউকে দেখা যায় না। এত রাতে আলো বা লোকজন দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। তবে আজকের ব্যাপার আলাদা। ফলি নামে কে একটা ছেলে লাইনের ধারে মারা গেছে, তাকে নিয়ে নানা গুজব। কেউ বলছে খুন। একটা রিকশাওয়ালা খুনির নাম বলেছে গগন। এই নিয়ে পাড়ায় ভীষণ উত্তেজনা। প্রায় সবাই জেগে গুজগুজ ফুসফুস করছে।
গুজব নানকের পছন্দ নয়। সে জানে কংক্রিট ফ্যাক্ট ছাড়া কোনও ঘটনাই গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাস্য নয়। তার নিজের বিষয় হল ইতিহাস, যা কিনা বারো আনাই কিংবদন্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অধিকাংশই কেচ্ছাকাহিনি। তা ছাড়া ইতিহাস মানেই হচ্ছে রাজা বা রাজপরিবারের উত্থান-পতনের গল্প। তাই ইতিহাস সাবজেক্টটাকে দুচোখে দেখতে পারে নানানক। তার ইচ্ছে এমন ইতিহাস লেখা হোক যা সম্পূর্ণ সত্যমূলক এবং সমাজবিবর্তনের দলিল হয়ে থাকবে। ইতিহাস মানে গোটা সমাজের ইতিহাস। কিন্তু পাঠ্য প্রাচীন ইতিহাসগুলো সেদিক থেকে বড়ই খণ্ডিত।
নানক দাঁড়িয়ে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিল। চারদিককার পৃথিবী সম্পর্কে সে এখন কিছুটা উদাস এবং নিস্পৃহ। তার সবচেয়ে প্রিয় গ্রন্থটি হল রবিনসন ক্রুশো। এই প্রায়-শিশুপাঠ্য বইটি যে কেন তার প্রিয় তা এক রহস্য। তবে নানক দেখেছে, যখনই তার মন খারাপ হয় বা অস্থিরতা আসে তখন রবিনসন ক্রুশো পড়লেই মনটা আবার ঠিক হয়ে যায়। শুনলে লোকে হাসবে কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি।
আজ বিকেল থেকে নানকের মনটা খারাপ, তার প্রতুবিদ বন্ধু অমলেন্দু এসেছিল, ছুরিটা নেড়েচেড়ে দেখে বলেছে, এ হল একেবারে ব্রিটিশ আমলের বস্তু। বয়স ষাট-সত্তর বছরের বেশি নয়। তবে একটু ঐতিহাসিক নকলে তৈরি হয়েছিল বটে। ননশোটা টাকা গালে চড় দিয়ে নিয়ে গেহে হে।
নানক চৌধুরী তখন থেকেই রবিনসন ক্রুশো পড়ে গেছে। এখন মনটা অন্যমনস্ক। নানক চৌধুরী নিজেকে সেই নিরালা দ্বীপবাসী রবিনসন ক্রুশো বলে ভাবতে ভারী ভালবাসে। সে যদি ও রকম জীবন পায় তবে ফ্রাইডের মতো কোনও সঙ্গীও জোটাবে না। এ রকম একা থাকবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে নানক হঠাৎ নরেশের বাড়ির উঠোনে টর্চের আলো দেখতে পায়। সেই সঙ্গে দুটো ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি হলেও চিনতে অসুবিধে নেই। বিপুল মোটা বেঁটে শোভারানিকে অন্ধকারেও চেনা যায়। আর গরিলার মতো হোঁতকা জোয়ান-জোয়ান চেহারার গগনকেও ভুল হওয়ার কথা নয়।
দুজনে করছে কী ওখানে? কোনও লাভ-অ্যাফেয়ার নয় তো!
একটু বাদেই নানক দেখে গগন দেয়াল ডিঙোচ্ছে। শোভারানি টর্চ জ্বেলে ধরে আছে। গগন দেয়ালের ওপাশে নেমে না-যেতে যেতেই পুলিশের গাড়ির আওয়াজ রাস্তায় এসে থামে। ভারী বুটের শব্দ। কিছু টর্চের আলো এলোমেলো ঘুরতে থাকে।
তা হলে এই ব্যাপার।
নানক চৌধুরী লুঙ্গির ওপর একটা পাঞ্জাবি চড়িয়ে ঘর থেকে বেরোয়। নিজের ঘরে তালা দেওয়া তার পুরনো অভ্যাস। বাড়ির কারও বিনা প্রয়োজনে তার ঘরে ঢোকা নিষেধ। তালা দিয়ে নানক নীচে নেমে আসে। চাকরকে ডেকে সদর দরজা বন্ধ করতে বলে রাস্তায় বেরোয়।
মুখোমুখি একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা। নানক বলে, কাউকে খুঁজছেন?
অফিসার বলে, হ্যাঁ। গগন নামে কাউকে চেনেন?
চিনি।
লোকটা ঘরে নেই। পালিয়েছে।
নানক বলে, হ্যাঁ। আমি পালাতে দেখেছি।
কোন দিকে?
পিছনের দেয়াল টপকে ল্যাবরেটারির মাঠ দিয়ে। এখন আর তাকে পাবেন না। বড় রাস্তায় পৌঁছে গেছে।
কখন গেল?
মিনিট দশ-পনেরো হবে। নরেশ মজুমদারের স্ত্রীও ছিল। পালাবার সময় টর্চ দেখাচ্ছিল।
আপনি কে?
নানক চৌধুরী প্রফেসর।
নানক চৌধুরীর পরিচয় পেয়ে পুলিশ অফিসার খুব বেশি প্রভাবিত হননি। শুধু বললেন পালিয়ে যাবে কোথায়?
এত রাতেও পাড়ার লোক মন্দ জমেনি চার দিকে। তা ছাড়া চারিদিকের বাড়ির জানালা বা বারান্দায় লোক দাঁড়িয়ে দেখছে।
রাস্তার ভিড় থেকে সুরেন খাঁড়া এগিয়ে এসে একটু বিরক্তির সঙ্গে বলে, মদনদা, তোমরা একটা মাতাল আর চ্যাংড়া রিকশাওলার কথায় বিশ্বাস করে অ্যারেস্ট করতে এলে, এটা কেমন কথা?
পুলিশ অফিসারের নাম মদন। সুরেনের সঙ্গে এ অঞ্চলের সকলের খাতির। অফিসার একটু দ্রু কুঁচকে বলেন, অ্যারেস্ট করতে এসেছি বললে ভুল হবে। আসলে এসেছি এনকোয়ারিতে। তা তুমি কিছু জানো নাকি সুরেন?
কী আর জানব? শুধু বলে দিচ্ছি, কালুর কথায় নেচো না। ও মহা বদমাশ। গগনকে আমরা খুব ভাল চিনি। সে কখনও কোনও ঝাটে থাকে না।
থাকে না তো পালাল কেন?
সে পালিয়েছে কে বলল! পালায়নি। হয়তো গা-ঢাকা দিয়েছে ভয় খেয়ে। মদনদা, তোমাদের কে না ভয় খায় বলো?
পুলিশ অফিসার একটু হেসে বললেন, আরও একজন এভিডেন্স দিয়েছে, শুধু কালুই নয়। গগনবাবুর ল্যান্ডলর্ড নরেশ মজুমদার। আবার এই প্রফেসর ভদ্রলোক বলেছেন, গগনের সঙ্গে একটু আগেই নাকি মিসেস মজুমদারকেও দেখা গেছে। তোমাদের এ পাড়ার ব্যাপার-স্যাপার বেশ ঘোরালো দেখছি।