সেই থেকে কালুর সব দুঃখবোধ আর কান্না বিদায় নিয়েছে। কেমন যেন ভোতা হয়ে গেছে সে। মনে কিছু ভুরভুরি কাটে না। গাল খেলে গাল দেয়, মার খেলে উলটে মার দেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যস, এই ভাবেই যতদিন বেঁচে থাকা যায়। কালু যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে শিখেছে তা হল টাকা। টাকার মতো কিছু হয় না।
সেলিমপুরে সওয়ারি ছেড়ে রিকশাওয়ালা মগন ফাঁড়ির উলটোদিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বসে ছিল। যাদবপুরে ফিরবে, সওয়ারি পাওয়ার লোভে খানিক অপেক্ষা করছিল।
কালু গিয়ে মগনকে বলল, নিয়ে চলো দেখি মগনদা।
তোর গাড়ি কে থায়?
ছেড়ে এসেছি, পুলিশ ধরে আনল একটু আগে।
মগন ঝুঁকে বলল, পুলিশ। আই বাপ। কী হয়েছিল?
সে অনেক কথা, পরে কোনও সময়ে শুনো।
পেঁদিয়েছে তোকে?
ও শালার সম্বন্ধীর পুতেরা কাকে না প্যাদায়?
মগন রিকশার হুড তুলে দিয়ে বলল, চেপে বোস, শালারা আবার টের না পায় যে আমার গাড়িতে উঠেছিস!
মগন রিকশা ছেড়ে জোরহাল।
কালু কেতরে বসেছিল তার সিটে, মারধর নয়, আসলে খিদেয় পেট ব্যথা করছে। মদের ঝোঁকটা উবে গেছে কখন। এখন পেটে একটা চোঁ-ব্যথা। তবে তার মনটা এই ভেবে খুব ভাল লাগছিল যে পুলিশের হাতে পড়েও সে কারও নাম বলেনি।
এইট বি বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে মগন বলল, মানিককে তিন দিনের পয়সা দিইনি।
কালু দাঁত বের করে বলল, আমার এক হর বাকি কাল থেকে গাড়ি দেবে না। তার ওপর পুলিশ লেগেছে।
দুদিন জোর বৃষ্টি হলে ভাল সওয়ারি পাওয়া যায়।
ইচ্ছেমতো তো আর বৃষ্টি হবে না।
মগন গাড়ি মালিয়ে বাড়িতে তুলে রাখতে বিজয়গড় গেল।
কালু স্টেশন রোডের মুখখানিক দাঁড়িয়ে আর-একটা রিকশা খুঁজল। পেল না, হাঁটতে লাগল। বাড়ি না গেলেও হয়। গরফা পর্যন্ত ঘটতে ইচ্ছে করছে না খিদে পেটে।
স্টেশনের গায়ে একটা তেলেভাজার ঝোপড়ার দোকান আছে। সেটা চালায় বিশে, তার দোস্ত, সেখানে গেলে কিছু খাবার জুটতে পারে। শোওয়ার কার অভাব নেই স্টেশনে গামছা পেতে পড়ে থাকলেই।
বিশে জেগে ছিল, কেপড়ায় হরিকেন জ্বলছে। এই বিধিকিধিরি কম দামের ট্রানজিস্টারে কোথাকার একটা পুরনো হিন্দি গান হচ্ছে।
তাকে দেখে বিশে দাঁতের বিড়ি ফেলে দিয়ে, পরশু মাল খাওয়াবি কথা ছিল।
কালু বলে, কাল খাওয়াব।
তোর শালা মুখ না ইয়ে।
বেশি মেজাজ লিস না বিশে, আমার কচকচে সাড়ে চারশো টাকা আছে।
যা যা।
কিছু পেটের ব্যবস্থা হবে?
বিশে বলল, শালা রোজ এসে জ্বালালে এবার ঝাপড় খাবি।
তা বলে বিশে ফিরিয়ে দেয় না। মুড়ি, ছোলাসেদ্ধ আর ঠাণ্ডা বেগুনি খাওয়ায়। তারপর দুই বন্ধুতে বিড়ি ধরিয়ে গিয়ে স্টেশনে শুয়ে পড়ে গল্পগাছা করতে থাকে। বিশের মা ঝোপড়া আগলে রাখে।
বিশে সব শুনে বলে, তুই শালা ঘুমচক্করে পড়বি। খুনখারাবি নিয়ে দিল্লাগি নয় দোস্ত। সত্যি কথা বল তো কাউকে দেখেছিলি?
স্টেশনের শক্ত মেঝের ওপর-চট পেতে শোয়া কালু ফিরে বিশের দিকে চেয়ে বিড়িতে টান মেরে বলে, তুই লাশটা দেখেছিলি?
বিশে বলে, দেখব না কেন? লাইনের ধারে দিনভর পড়ে ছিল। অনেক বার গিয়ে দেখেছি।
চিনতে পেরেছিলি?
বিশে মাথা নেড়ে বলে, খুব। ফলি গুন্ডাকে কে না চেনে? এ সব জায়গাতেই আড্ডা ছিল। সব সময়ে ট্রেনে আসত আর ট্রেনেই চলে যেত।
ট্যাবলেট বেচতে আসত যে আমিও জানি। কিন্তু ট্রেন আসত কেন বল তো?
মনে হয় পাড়ায় ঢুকতে ভয় পেত। বাসে-টাসে এলে তো বড় রাস্তা বা স্টেশন রোড ধরে আসতে হবে। ও সব জায়গায় ওর কোনও বিপদ ছিল মনে হয়।
কালু আর-একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, লুকিয়ে চুরিয়ে আসত তা হলে!
বিশে গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু ফলিরও দল ছিল। সন্তোষপুর, পালবাজার, স্টেশন রোড এ সব এলাকার বিস্তর মস্তান ছিল ওর দোস্ত। আমার দোকানে এসে ইট পেতে বসে কত দিন দিশি মাল আর তেলেভাজা খেয়েছে।
তুই তা হলে ভালই চিনতি?
বললাম তো।
তুই খুনটা নিজে চোখে দেখলি?
নিজের চোখে।
খুনিকেও চিনলি?
কালু হেসে বলে, নাম বলব না তা বলে। চিনলাম।
বিশে একটা আস্তে লাথি মারল কালুর পাছায়।
তারপর বলল, মালকড়ি ঝাকবি?
ঝেঁকেছি, কাল তোকে মাল খাওয়াব।
বিশে ঘুমোয়। কালুর অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। গালটা ফুলে টনটনে ব্যথা হয়েছে। মাজাতেও ব্যথা বড় কম নয়। এপাশ-ওপাশ করে সে একটু কোঁকাতে থাকে।
শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল কাল। উঠতে অনেক বেলা হল। দেখল, বিশে উঠে গেছে। স্টেশনে গিজগিজ করছে।
লাইন পার হয়ে কালু পাড়ায় ঢুকে বাড়িমুখো হাঁটতে থাকে।
দরজায় পা দিতে-না-দিতেই মা চেঁচিয়ে বলে, হারামজাদা বজ্জাত, কার সঙ্গে লাগতে গিয়েছিলি? কাল রাতে চারটে গুন্ডা এসে বাড়ি তছনছ করেছে। ছেলেদুটোকে ধরে কী হেনস্থা, যা বাড়ি থেকে দূর হয়ে! গুন্ডা বদমাশ কোথাকার!
০৭. নানক চৌধুরী
০৭.
নানক চৌধুরীর পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে পাড়ার অনেকখানি দেখা যায়।
ঘরে নানক চৌধুরী একাই থাকে। বাড়ির কারও সঙ্গেই হলাহলি-গলাগলি নেই, এমনকী স্ত্রীর সঙ্গেও না। নিজের ঘরে বইপত্র আর নানান পুদ্রিব্যের সংগ্রহ নিয়ে তার দিন কেটে যায়। কাছেই একটি কলেজে নানক অধ্যাপনা করে। না করলেও চলত, কারণ টাকার অভাব নেই।
টাকা থাকলে মানুষের নানা রকম বদ খেয়াল মাথা চাড়া দেয়। নানক চৌধুরী সেদিক দিয়ে কঠোর মানুষ। মদ-মেয়েমানুষ দূরের কথা নানক সুপুরিটা পর্যন্ত খায় না। পোশাকে বাবুয়ানি নেই, বিলাসব্যসন নেই। তবে খরচ আছে। জমানো টাকার অনেকটাই নানকের খরচ হয় হাজারটা পুরাদ্রব্য কিনতে গিয়ে। ইতিহাসের অধ্যাক হলেও নানক প্রত্নবিদ নয়। তাই সেসব জিনিস কিনতে গিয়ে সে ঠকেছেও বিস্তর। কেউ একটা পুরনো মূর্তি কি প্রাচীন মুদ্রা এনে হাজির করলেই নানক ঝটপট কিনে ফেলে। পরে দেখা যায় যে জিনিসটা ভুয়া। মাত্র দিন সাতেক আগে একটা হা-ঘরে লোক এসে মরচে-ধরা একটা ছুরি বেচে গেছে। ছুরিটা নাকি সিরাজদৌল্লার আমলের। প্রায় ন’শ টাকা দণ্ড দিয়ে সেটা রেখেছে নানক।