কালু একটা গুজব ছড়িয়েছে।
কী?
ফলিকে যে খুন করেছে তাকে নাকি ও দেখেছে।
গগন মাথা নেড়ে বলল, জানি।
কী জানেন?
কালু ও কথা আমাকেও বলেছে।
কে খুন করেছে তা বলেনি? শোভা ঝুকে খুব আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে।
গগন মাথা নাড়ে, না। ও পাঁচশো টাকা দাবি করে খুনির কাছে। বলবে না।
শোভা হেসে বলে, সেই পাঁচশো টাকা কালু পেয়ে গেছে।
শোভারানির হাসি এবং শোকের অভাব দেখে গগন খুব অবাক হয়। ফলির মৃত্যুতে কি শোভার কিছু যায়-আসেনি? বোনপোটা মরে গেল, তবু ও কীরকম যেন স্বাভাবিক।
গগন ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, কার কাছে পেয়েছে?
শোভা অদ্ভুত একটু হেসে বলল, ও বলছে, টাকা নাকি ওকে আপনি দিয়েছেন।
আমি! আমি টাকা দিয়েছি!
খুব আস্তে গগনের বুদ্ধি কাজ করে। প্রথমটায় সে বুঝতেই পারল না ব্যাপারটা কী। ভেবে ভেবে জোড়া দিতে লাগল। তাতে সময় গেল খানিক।
শোভা বলল, একটু আগে কালুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
গগন তেমনি দেবী-দর্শনের মতো উর্ধ্বমুখ হয়ে নীরব থাকে। বুঝতে সময় লাগে তার। তারপর হঠাৎ বলে, আমি ওকে টাকা দিইনি।
শোভা ঠোঁট ওলটাল! বলল, ও তো বলছে!
আর কী বলছে?
শোভা হেসে বলে, খুনির নামটাও বলেছে।
কে?
বলেই গগন বুঝতে পারে তার গলার স্বর তার নিজের ফাঁকা মাথার মধ্যে একটা প্রতিধ্বনি তুলল, কে!
শোভা তার চোখে চেয়ে থেকে বলল, ও আপনার নাম বলছে
আমি! আমার নাম—- বলে গগন মাথায় হাত দিয়ে বলে, না তো ও মিথ্যা কথা বলছে।
শোভা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বলল, কালু মদ-গাঁজা খায়। ওর কথা কে বিশ্বাস করে, আহাম্মক ছাড়া। তবে ফলিকে কেউ খুন করে থাকলেও অন্যায় করেনি আমি তো সেজন্য জোড়াপাঁঠা মানসিক করে রেখেছি।
গগন উত্তর দিতে পারে না মাথাটা ফাঁকা লাগছে। সে শুধু শোভার দিকে চেয়ে থাকে।
শোভা বলে, শুনুন যদি ফলিকে কেউ মেরে থাকে তো আত্মার দুঃখের কিছু নেই। আমার স্বামী কাঁদছেন। তার বোধহয় কাঁদবারই কথা। তিনি ঠিক করেছিলেন, আমাদের বিষয়-সম্পত্তি সব ফলির লমে লিখে দেবেন। উইল নাকি করেও ছিলেন। আমি সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারিনি। ফলির জন্ম ভাল নয়।
গগন উত্তর দিতে পারছিল না। তবু মাথা নাড়ল।
শোভা বলল, আপনি বা যে-কেউ ওকে খুন করে থাকলে ভাল কাজই হয়েছে। পেস্তা নামে যে বাচ্চা মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল, সে এখনও আমার কাছে আসে। তার বোধহয় আর বিয়ে হবে না। ফলির গুণকীর্তির কথা কে না জানে! অপু আমার স্বামীকে কিছু বোঝানো যাবে না। তিনি সম্ভবত পুলিশ ডেকে আজ রাতেই আপনাকে গ্রেফতার করাকেন।
আমাকে!
শোভা সামান্য উমার সঙ্গে বলে, ও রকম ভ্যাবলার মতো অছেন কেন? এ সময়ে বুদ্ধি ঠিক না রাখলে ঝামেলায় পড়বেন।
গগন হঠাৎ বলল, কী করব?
শোভা বলে, কী আর করবেন, পালাবেন!
গগন দিশাহারার মতো বলল, পালাব কেন?
সেটা বুঝতে আপনার সময় লাগবে। শরীরটাই বড়, বুদ্ধি ভীষণ কম। পুলিশে ধরলে আটক রাখবে, মামলা হবে, সে অনেক ব্যাপার। বরং পালিয়ে গেলে ভাবার সময় পানে।
কোথায় পালাব?
সেটা যেতে যেতে ভাববেন। এখন খুব বেশি সময় নেই। এইখান দিয়ে উঠে আসতে পারবেন?
গগন হাসল এবার। সে শরীরের কসরতে ওস্তাদ-লোক। গ্যারাজঘরের ছাদের দরজায় ওঠা তার কাছে কোনও ব্যাপার নয়। মা নেড়ে বলল, খুব।
তা হলে বাতিটা নিবিয়ে উঠে আসুন। এখান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ভাল রাস্তা আছে। কেউ দেখবে না। দেয়াল টপকে ওদিকে এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের কারখানার মাঠ দিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় উঠবেন। দেরি করবেন না। উঠে আসুন।
গগন বাতি নিভিয়ে দেয়। শোভা টর্চ জেলে রাখে। গগন পোশাক পরে নেয়। দুটো-একটা টুকিটাকি দরকারি জিনিস ভরে নেয় ঝোলা ব্যাগে। তারপর হাতের ভর দিয়ে দরজায় উঠে পড়ে।
শোভা টর্চ জ্বেলে আগে আগে পথ দেখিয়ে দেয়। মেথরের আসবার রাস্তায় এলে শোভারানি তাকে বলে, এই রাস্তা দিয়ে চলে যান। টাকা লাগবে?
গগন মাথা নাড়ে, না।
শোভা হেসে বলে, লাগবে। সদ্য সদ্য পাঁচশো টাকা বেরিয়ে গেছে, এখন তো হাত খালি!
গগন বিস্মিত ও ব্যথিত হয়ে তাকায়।
আর শোভারানি সেই মুহূর্তে তাকে প্রথম স্পর্শ করে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে তার প্যান্টের পকেটে বোধহয় কিছু টাকাই গুঁজে দেয়। খুব নরম স্বরে বলে, বেগম খারাপ। আমি খারাপ নই। আমি বিশ্বাস করি না যে আপনি খুন করেছেন। এখন যান। গ্যারাজ-ঘরের ভিতরটা আমি উঁচু করে দেব। সময়মতো ফিরে এসে দেখল্লে ঘরটা অনেক ভাল হয়ে গেছে। আর জিনিসপত্র যা রইল তা আমি দেখে রাখ। এখন আসুন তো।
গগন মাথা নাড়ে। তারপর আস্তে করে গিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের পাঁচিল টপকায়। মাঠ পেরোয়।
কয়েকটা টর্চবাতি ইতস্তত কাকে যেন খুঁজছে। গগন মাথা নিচু করে এগোয়। একটা বড় গাড়ি এসে থামল কাছেই কোথাও। গগন বাদবাকি পটুকু দৌড়ে পার হয়ে যায়। ফের পাঁচিল টপকে বড়রাস্তায় পড়ে।
রাতের ফাঁকা রাস্তা। কোথাও কোনও যানবাহন নেই। কেবল একটা ট্যাক্সি সওয়ারি খালাস করে ধীরে ফিরে যাচ্ছে। গগন হাত তুলে সেটাকে থামায়। সচরাচর সেট্যাক্সিতে চড়ে না। পয়সার জন্যও বটে, তা ছাড়া বাবুয়ান তার সয়না। আজ উঠে বসল। কারণ অবস্থাটা আজ গুরুতর। তা ছাড়া শোভারানির দেওয়া বেশ কিছু টাকাও আছে পকেটে।
পৃথিবীটাকে ঠিক বুঝতে পারে না গগনচাঁদ। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ মেঘলা করে আসে। গ্যারাজ-ঘরে জল ওঠে আধ-হাটু। জীবনটা এ রকমই। মাঝে মাঝে বিনা কারণে এ রকম পালাতে