ভূতের মতো একা একা গগন জিমনাশিয়ামে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে এধার-ওধার দেখে। মেঝেয় বারবেলের চাকা পড়ে আছে কয়েকটা। পায়ের ডগা দিয়ে একটা চাকা ঠং করে উলটে ফেলল সে। এক হাতে রিং ধরে একটু ঝুল খেল। প্যারালাল বার-এ উঠে বসে রইল কিছুক্ষণ। ভাল লাগছে না। মনটা আজ ভাল নেই! ফলিকে কে মারল? কেন ফলি ও সব নেশার ব্যবসা করতে গেল?
আজ সন্ধেবেলা ফিরে এসে গ্যারাজ-ঘরে বসে সে অনেকক্ষণ উৎকণ্ঠ থেকেছে। না, শোভারানিদের ঘর থেকে তেমন কোনও সন্দেহজনক শব্দ হয়নি! রাত নটায় নরেশও ফিরে এল। স্বাভাবিক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল ওপর থেকে। তার মানে ওরা এখনও ফলির মৃত্যুসংবাদ পায়নি। বড় আশ্চর্য কথা! ফলিকে এখানে সবাই একসময়ে চিনত। তবু তার মৃতদেহ কেন কেউ শনাক্ত করতে পারেনি? কেবলমাত্র পুলিশ আর কালু ছাড়া! তাও পুলিশ বলেছে, ফলি অ্যাবসকন্ডার। ফলি ফেরারই বা ছিল কেন?
মাথাটা বড্ড গরম হয়ে ওঠে।
গগনচাঁদের বুদ্ধি খুব তৎপর নয়! খুব দ্রুত ভাবনা-চিন্তা করা তার আসে না! সবসময়ে সে ধীরে চিন্তা করে। কিন্তু যা সে ভাবে তা সবসময়ে একটা নির্দিষ্ট যুক্তি-তর্ক এবং গ্রহণ বর্জনের পথ ধরে চলে। হুটহাট কিছু ভাবা তার আসে না। গগন বহুকাল ধরে নিরামিষ খায়। সম্ভবত নিরামিষ খেলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কিছু ধীর হয়ে যায়। নিরামিষ খাওয়ার পিছনে আবার গগনের একটা ভাবপ্রবণতাও আছে। ছটফটে জ্যান্ত জীব, জালে বদ্ধ বাঁচার আকুলতা নিয়ে মরে যাওয়া মাছ কিংবা ডিমের মধ্যে অসহায় ভ্রণ, এদের দেখে তার বড় মায়া হয়। আরও একটা কারণ হল, আমিষ খেলে মানুষের শরীরের স্বয়ং-উৎপন্ন বিষ টকসিন খুব বেড়ে যায়। টকসিন বাড়লে শরীরে কোনও রোগ হলে তা বড় জখম করে দিয়ে যায় শরীরকে। কেউ কেউ গগনকে বলেছে, নিরামিষভোজীরা খুব ধীরগতিসম্পন্ন, পেটমোটা। গগন তার উত্তরে তৃণভোজী হরিণ বা ঘোড়ার উল্লেখ করেছে, যারা ভীষণ জোরে ছোটে। তাদের পেটও মোটা নয়। নিরামিষ খেয়ে গগনের তাগদ কারও চেয়ে কম নয়। গতিবেগ এখনও বিদ্যুতের মতো। জুডো বা বক্সিং শিখতে আসে যারা তারা জানে গগন কত বড় শিক্ষক। তাও গগন খায় কী? প্রায় দিনই আধ সেরটাক ভাল আর সবজি-সেদ্ধ, কিছু কাঁচা সবজি, দু-চারটে পেয়ারা বা সময়কালে কমলালেবু বা আম, আধ সের দুধ, সয়াবিন, কয়েকদানা ছোলাবাদাম। তাও বড় বেশি নয়। শরীর আন্দাজে গগনের খাওয়া খুবই কম। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনও দিনই সে বেশি মাথা ঘামায় না। এইসব মিলিয়ে গগন। ধীরবুদ্ধি, শান্ত, অনুত্তেজিত, কোনও নেশাই তার নেই।
মেয়েমানুষের দোষ নেই, তবে আকর্ষণ থাকতে পারে।
যেমন বেগম। ফলি যখন গগনের কাছে কসরত করা শিখত, তখন বহুবার বেগম এসেছে জিমন্যাশিয়ামে। সে বেড়াতে আসত বোনের বাড়ি, সেই তকে জিমন্যাশিয়ামে ছেলেকে দেখে যেত। ব্যায়ামাগারটাই ছিল বলতে গেলে ফলির বাসস্থান।
গগনের আজও সন্দেহ হয়, শুধু ছেলেকে দেখতেই আসত কি না বেগম। বরং ছেলেকে দেখার চেয়ে ঢের বেশি চেয়ে দেখত গগনকে! তার তাকানো ছিল কী ভয়ংকর মাদকতায় মাখানো। বড় বড় চোখ, পটে-আঁকা চেহারা, গায়ের রং সত্যিকারের রাঙা। রোগা নয়, আবার কোথাও বাড়তি মাংস নেই। কী চমৎকার ফিগার! প্রথমটায় গগনের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু গগন বিভিন্ন ব্যায়ামকারীর কাছে ঘুরে ঘুরে নানা জিনিস শেখাচ্ছে, স্যান্ডো গেঞ্জি আর চাপা প্যান্ট পরা তার বিশাল দেহখানা নানা বিভঙ্গে বেঁকেছে, দুলছে বা ওজন তুলবার সময় থামের মতো দৃঢ় হয়ে যাচ্ছে, এ সবই বেগম অপলক চোখে দেখেছে। বেগমের বয়স বোঝে কার সাধ্য! তাকে ফলির মা বলে মনে হত না, বরং বছর দু-তিনেকের বড় বোন বলে মনে হত। ফলি একদিন বলেছিল, মা চমৎকার সব ব্যায়াম জানে, জানেন গগনদা! এখনও রোজ আসন করে।
বেগম প্রথমে ভাববাচ্যে কথা বলত। সরাসরি নয়, অথচ যেন বাতাসের সঙ্গে কথা বলার মতো করে বলত, কত দিন এখানে চাকরি করা হচ্ছে? কিংবা জিজ্ঞেস করত, জামাইবাবুর সঙ্গে কারও বুঝি খুব খটাখটি চলছে আজকাল। পরের দিকে বেগম সরাসরি কথা বলত। যেমন একদিন বলল, আপনার বয়স কত বলুন তো?
বিনীতভাবে গগন জবাব দিল, উনতিরিশ।
একদম বোঝা যায় না। বিয়ে করেছেন?
না।
কেন?
গগন হেসে বলে, খাওয়াব কী? আমারই পেট চলে না।
অত যার গুণ তার খাওয়ার অভাব!
তাই তো দেখছি।
আপনি ম্যাসাজ করতে জানেন?
জানি।
তা হলে আপনাকে কাজ দিতে পারি, করলেন?
গগন উদাসভাবে বলল, করতে পারি।
একটা অ্যাথলেটিক ক্লাব আছে, ফুটবল ক্লাব, খেলোয়াড়দের ম্যাসাজ করতে হবে। ওরা ভাল মাইনে দেয়।
গগন তখন বলল, আমার সময় কোথায়?
খুব হেসে বেগম বলল, তা হলে করবেন বললেন কেন? ওই ক্লাবে গেলে সব ছেড়ে যেতে হবে। হোলটাইম জব। সময়ের অভাব হবে না। আর যদি ছুটকো-ছাটকা মাসাজ করতে চান, পক্ষাঘাতের রুগি-টুগি, তাও দিতে পারি।
গগন বলি, ভেবে দেখব।
আসলে গগন ও সব করতে চায় না, সে চায় ছাত্র তৈরি করতে! ভাল শরীরবিদ, জিমন্যাস্ট, বক্সার, জুডো-বিশেষজ্ঞ। সে খেলোয়াড়দের পা বা রুগির গা মাসাজ করতে যাবে কেন?
কিন্তু ওই যে সে ম্যাসাজ জানে ওটাই তার কাল হয়েছিল। কারণ এবার বেগম নাকি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা মচকায়। খবর এল, ম্যাসাজ দরকার। প্রথমে গগন যায়নি। সে কিছু আন্দাজ করেছিল। কিন্তু বেগম ছাড়বে কেন? খবরের পর খবর পাঠাত। বিরক্ত হয়ে একদিন বাপুজি কলোনির বাড়িতে যেতে হয়েছিল গগনকে।