খুব তাড়াতাড়ি সন্তু রাস্তা পার হয়ে খানিক দূরে চলে আসে। সিংহীদের পাচিলটা কোথাও কোথাও ভাঙা। একটা ভাঙা জায়গা পেয়ে সন্তু অনায়াসে পাচিল টপকে বাগানে ঢুকে ঝোপঝাড় ভেঙে এগোয়। কালু এসে গেছে কি না দেখবার জন্য এধার-ওধার টর্চের আলো ফেলে। কোথাও কাউকে দেখা যায় না।
শিরিষ গাছের তলায় এসে সন্তু দাঁড়ায়। দুবার মুখে আঙুল পুরে সিটি বাজিয়ে অপেক্ষা করে।, কালু এখনও আসেনি। বরং খবর পেয়ে মশারা আসতে শুরু করে ঝাঁক বেঁধে। হাঁটু, হাত, ঘাড় সব চুলকোনিতে জ্বালা ধরে যায়। সন্তু দুচারটে চড়চাপড় মেরে বসে গা চুলকোয়। কালু এখনও আসছে না।
চার দিক ভয়ংকর নির্জন আর নিস্তব্ধ। ওই প্রকাও পুরনো আর ভাঙা বাড়িটায় সন্তু ওকে ফাঁসি দিয়েছিল। এই বাড়িতেই মরেছে সিংহবুড়ে। তার ওপর গতকাল দেখা লাশটার কথাও মনে পড়ে তার। ছেলেটার বয়স বেশি নয়, একটা বেশ ভাল জামা ছিল গায়ে, আর একটা ভাল প্যান্ট। ছেলেটার চুল লম্বা ছিল, বড় জুলপি আর গোঁফ ছিল। ওইরকম বড় চুল আর জুলপি রাখার সাধ সতুর খুব হয়। কিন্তু তার বাবা ননক চৌধুরী সন্তুকে মাসান্তে এক বার পপুলার সেলুন ঘুরিয়ে আনে। সেখানকার চেনা নাপিত মাথা স্ক্রু-কাট করে দেয়।
সন্তুর যে ভয় করছিল তা নয়। তবে একটু ছমছমে ভাব। কী যেন একটা হবে। ঠিক বুঝতে পারছে না স্যু, তবে মনে হচ্ছে অলকে কে যেন একটা দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠি আস্তে করে দো-বোমার পলতেয় ধরিয়ে দিচ্ছে। এখন জোর শব্দে একটা ভয়কর বিস্ফোরণ হবে।
হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে শব্দ ওঠে। সতু শিউরে উঠল। অবিকল নীলমাধরের সেই সড়ালে কুকুরটা যেমন জঙ্গল ভেঙে ধেয়ে আসত ঠিক তেমন শব্দ। সন্তুর হাত থেকে টর্চটা পড়ে গেল। আকাশে মেঘ চেপে আছে। চার দিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সত্ কেবল প্যান্টের পকেট থেকে তার ছোট্ট দুরিটা বের করে হাতে ধরে রইল। যেদিক থেকে শব্দটা আসছে সেদিকে মুখ করে মাটিতে উবু হয়ে বসে অপেক্ষা করছিল সে। হাত-পা ঠান্ডা মেরে আসছে, বুক কাঁপছে, সু খুব ভয় সন্তু পায় না। পালানোর চিন্তাও সে করে না।
একটু বাদেই সে ছোট্ট কেরোসিনের ল্যাম্পের আলো দেখতে পায়। রিকশার বাতি হাতে কালু আসছে। কিন্তু আসছে ঠিক বলা যায় না। কালু বাতিটা হাতে করে ভয়ংকর টলতে টলতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্পূর্ণ মাতাল।
সন্তু টর্চটা জেলে বলে, কালু, এদিকে।
কোন শালা রে-কালু চেঁচাল।
আমি সন্তু।
কোন সন্তু?-বলে খুব খারাপ একটা খিস্তি দিল কালু।
সন্তু এগিয়ে কালুর হাত ধরে বলে, আস্তে। চেঁচালে লোক জেনে যাবে।
কালু বাতিটা তুলে সন্তুর মুখের ওপর ফেলার চেষ্টা করে বলে, ওঃ, সন্তু!
হ্যাঁ।
আয়।
বলে কালু তার হাত ধরে টানতে টানতে পোড়া বাড়ির বারান্দায় গিয়ে ওঠে। তারপর সটান মেঝেতে পড়ে গিয়ে বলে, আজ বেদম খেয়েছি মাইরি! নেশায় চোখ ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সন্তু পাশে বসে বলে, কী বলবি বলেছিলি?
কী বলব?–কালু ধমকে ওঠে।
বলেছিলি বলবি। সেই খুনের ব্যাপারটা।
কোন খুন? ফলির?
হ্যাঁ।
কালু হা হা করে হেসে বলে, আমি পাঁচশো টাকা পেয়ে গেছি সন্তু, আর বলা যাবে না।
কে দিল?
যে খুনি সে।
লোকটা কে?
কালু ঝড়াক করে উঠে বসে বলে, তোকে বলব কেন?
বলবি না?
না। পাঁচশো টাকা কি ইয়ারকি মারতে নিয়েছি?
সন্তু খুব হতাশ হয়ে বলল, তুই বলেছিলি বলবি।
কালু মাথা নেড়ে বলে, পাঁচশো নগদ টাকা পেয়ে আজ অ্যাতো মাল খেয়েছি। আরও অনেক আছে, পালবাজারে সবজির দোকান দেব, নয়তো লন্ড্রি খুলব। দেখাব?
বলে কালু তার জামার পকেট থেকে একতাড়া দশ টাকার নোট বের করে দেখায়। বলে, গোন তো, কত আছে। আমি বেহেড আছি এখন।
সন্তু গুনল। বাস্তবিক এখনও চারশো পঁচাশি টাকা আছে।
বলল, খুনি তোকে কিছু বলল না?
না! কী বলবে! বলল, কাউকে বলবি না, তা হলে তোকেও শেষ করে ফেলব।
পাঁচশো টাকা দিয়ে দিল?
কালু মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বলে, দূর, পাঁচশো টাকা আর কী! এ রকম আরও কত ঝেঁকে নেব। সবে তো শুরু।
সন্ত উত্তেজিত হয়ে বলে, ব্ল্যাকমেল!
কালু চোখ ছোট করে বলে, আমি শালা ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার, আর তোমরা সব ভদ্রলোক, না?
ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার নয় রে। ব্ল্যাকমেল।
আমি ইংরিজি জানি না ভেবেছিস! রামগঙ্গা স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছিলাম ভুলে যাস না।
সন্তু এতক্ষণে হাসল। বলল, ব্ল্যাকমেল হল…
চুপ শালা। ফের কথা বলেছিস কি…।
বলে কালু লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
সন্তু কালুর হঠাৎ রাগ কেন বুঝতে না পেরে এক পা পেছিয়ে তেজি ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে বলল, এর আগে খিস্তি করেছিস, কিছু বলিনি। ফের গরম খাবি তো মুশকিল হবে।
কালু তার বাতিটা তুলে সন্তুর মুখের ওপর ফেলার চেষ্টা করে বলল, আহা চাদু! গরম কে খাচ্ছে শুনি?
বলে ফের একটা নোংরা নর্দমার খিস্তি দেয়।
সন্তু হাত-পা নিশপিশ করে। হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে ছুরিটা টেনে বের করে আনে সে। বেশি বড় না হলেও, বোতাম টিপলে প্রায় পাঁচ ইঞ্চি একটা ধারালো ফলা বেরিয়ে আসে। সস্তুর এখনও পর্যন্ত এটা কোনও কাজে লাগেনি।
ফলাটা কেরোসিনের বাতিতেও লকলক করে উঠল।
সন্তু বলল, দেব শালা ভরে।
দিবি? কালু উঠে দাঁড়িয়ে পেটের ওপর থেকে জামাটা তুলে বলল, দে না।
বলে জিব ভেঙিয়ে দু হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল দিতে থাকে।