রেল লাইন ধরে হেঁটে এসে গগনচাঁদ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠল। প্ল্যাটফর্মটা এখন প্রায় ফাঁকা। বুকিং অফিসের সামনে ফলওয়ালা ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে, তারই পাশে দাঁড়িয়ে সুরেন সিগারেট টানছে। গগন কিছু অবাক হল। সুরেন খাঁড়া বড় একটা ধূমপান করে না।
তাকে দেখেই সুরেন এগিয়ে এসে বলল, কী হল?
গগন কিছু বিস্মিতভাবেই বলে, তুমি ফলিকে চিনতে পারোনি?
ফলি। কোন ফলি? কার কথা বলছ?
যে ছেলেটা মারা গেছে। আমাদের নরেশ মজুমদারের শালির ছেলে।
সুরেন এ টু চুপ করে থেকে বলে, বেগমের সেই লুচ্চা ছেলেটা?
সেই। তোমার তো নো উচিত ছিল। তা ছাড়া তুমি যে বয়স বলেছিলে, ফলির বয়স তা নয়। কম করেও উনিশ কুড়ি বা কিছু বেশিই হতে পারে।
সুরেন গভীরভাবে বলল, চেনা কি সোজা? এই লম্বা চুল, মস্ত গোঁফ, মস্ত জুলপি, তা ছাড়া বহুকাল আগে দেখেছি, মনে ছিল না। তবে চেনা-চেনা ঠেকছিল বটে, তাই তো তোমাকে ধরে আনলাম। ও যে ফলি তা জানলে কী করে!
কালুর কাছ থেকে বের করলাম। বিড়ি-দেশলাইয়ের পয়সা দিতে হয়েছে।
সুরেন একটা খারাপ গালাগাল দিয়ে বলল, ব্যাটা বেঁচে আছে এখনও? থাপ্পড়টা তা হলে তেমন লাগেনি।
অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। অত জোরে মারা তোমার উচিত হয়নি সুরেন। ওরা সব ম্যালনিউট্রিশনে ভোগে, জীনশক্তি কম, বেমক্কা লাগলে হার্টফেল করতে পারে।
রাখো রাখো। বোতল বোতল বাংলা মদ সাফ করে গাঁজা টেনে রিকশা চালিয়ে বেঁচে আছে, আমার থামড়ে মরবে? এত সোজা নাকি! ওদের বেড়ালের জান।
গগনচাঁদ হেসে বলে, তুমি নিজের থাপ্পড়ের ওজনটা জানো না। সে যাক গে, কালু মরেনি। এখন দিব্যি উঠে এসেছে।
ভাল। মরলে ক্ষতি ছিল না।
গগন শুনে হাসল।
দুজনে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ফিরতে লাগল। কেউ কোনও কথা বলছে না।
০৪. উঁকি মেরে
০৪.
সন্তু একবার উঁকি মেরে তার বাবার ঘর দেখল। তার বাবা নানক চৌধুরী ইদানীং দাড়ি রাখছে। বড় পাগল লোক, কখন কী করে ঠিক নেই। এই হয়তো আধ হাত দাড়ি, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল হয়ে গেল। ফের একদিন গিয়ে দাড়ি কামিয়ে, মাথা ন্যাড়া করে চলে এল। তবুনানক চৌধুরীকে নিয়ে কেউ বড় একটা হাসাহাসি করে না। সবাই সমঝে চলে। একে মহা পণ্ডিত লোক, তার ওপর রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ব্ৰজ দত্ত নামে মারকুট্টা ছেলেকেও একবার লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল নানক চৌধুরী। কারণ ব্রজ দত্ত পাড়ার একটা পাগলা ল্যাংড়া লোককে ধরে মেরেছিল। সেই পাগলা আর ল্যাংড়া রমণী বোস নাকি বলে বেড়িয়েছিল যে ব্ৰজ দত্ত আর সাঙাতরা একরকম নেশা করে, তা মদের নয় কিন্তু মদের চেয়েও ঢের বেশি সাংঘাতিক।
সন্তু পরদা সরিয়ে উঁকি মেরে সাবধানে বাবাকে দেখে নেয়। ঘরটা অন্ধকার, কেবল টেবিল ল্যাম্পের ছোট্ট একটু আলো জ্বলছে, আর চৌধুরীর বড়সড় অন্ধকার ছায়ার শরীরটা ঝুঁকে আছে বইয়ের ওপর। পাড়ায় বোমা ফাটলেও নানক চৌধুরী এ সময়ে টের পায় না।
কালু আজ সন্তুর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। কাল রাতে লাশ দেখে ফেরার পথে কালু বলেছিল, স্যু, খুনটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু ভয় খাই যদি শালা খুনেটা জানতে পারে যে আমি দেখেছি, তো আমাকেও ফুটিয়ে দেবে। তাই তোকে সব বলব, কাল সিংহীদের বাগানে রাত আটটায় থাকবি।
সন্তু বলল, কাল কেন? আজই বল না।
কালু মাথা নেড়ে বলে, আজ নয়। আমি আগে ভেবে-টেবে ঠিক করি, মাথাটা ঠান্ডা হোক। আজ মাথাটা গোলমাল লাগছে।
সন্তু বলল, কত টাকা পাবি বললি?
পাঁচশো। তাতে কদিন ফুর্তি করা যাবে। রিকশা টানতে টানতে গতর ব্যথা। পাঁচশো টাকা পেলে পালবাজারে সবজির দোকানও দিতে পারি।
সন্তু ব্ল্যাকমেল ব্যাপারটা বোঝে। সে তাই পরামর্শ দিল, পাঁচশো কেন? তুই এক হাজারও চাইতে পারিস।
দেবে না।
দেবে। খুনের কেন্স হলে আরও বেশি চাওয়া যায়।
দুর!- কালু ঠোঁট উলটে বলে, বেশি লোভ করলেই বিপদ। আজকাল আকছার খুন হয়। কজনকে ধরছে পুলিশ! আমাদের আশেপাশে অনেক খুনি ঘুরে বেড়াচ্ছে ভদ্রলোকের মতো। খুনের কেসকে লোকে ভয় পায় না।
সন্তু কাল রাতে ভাল ঘুমোয়নি। বলতে কী সেকাল থেকে একটু অন্য রকম বোধ প্রছে। খুন সেকখনও দেখেনি বটে, কিন্তু বইতে খুনের ঘটনা পড়ে আর সিনেমায় খুন দেখে সে ইদানীং খুনের প্রতি খুব একটা আকর্ষণ বোধ করে। তার ওপর যদি সেই খুনের ঘটনার গোপন তথ্যের সঙ্গে সে নিজেও জড়িয়ে পড়ে তবে তো কথাই নেই।
রাত আটটা বাজতে চলল। দেয়ালঘড়িতে এখন পৌনে আটটা। এ সময়ে বাড়ির বাইরে বেরোনো খুবই বিপজ্জনক। নানক চৌধুরী, তার বাবা, যাকে সে আড়ালে নানকু বলে উল্লেখ করে, সে যদি পায় তো একতরফা হাত চালাবে। নাক চৌধুরী ব্যায়ামবীর বা ওভাষাকে ভয় পায় না, তা ছেলের গায়ে হাত তুলতে তার আসবে কেন?
তবু যেতেই হবে। সেই ভয়ংকর গুপ্ত খবরটা কালু তাকে দিয়ে যাবে আজ।
সন্তু রবারসোলের জুতো পরে আর একটা দুই সেল টর্চবাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সিংহীদের বাড়ির বাগান ভাল জায়গা নয়। পোডড়াবাড়ির মতো পড়ে আছে। সেখানে প্রচুর সাপখোপের আচ্ছা।
মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আজ মাস্টারমশাইয়ের আসার দিন নয়। কাজেই সন্তু পড়ার ঘরের বাতিটা জ্বেলে একটা বই খুলে রেখে বেরিয়ে পড়ল। মা যদি আসে তো ভাববে ছেলে পড়তে পড়তে উঠে বাথরুমে বা ছাদে গেছে।