সোমেন দেখল, মরা ইঁদুর।
মেয়েদের একজন সন্দিহান চোখ তুলে বলে—বিষ দিয়ে মারোনি তো দিদি?
মেয়েটি কপালের চুলের গুছি সরিয়ে অবহেলা আর অহংকারভরে বলল—বিষ দিয়ে মারব কেন? আছড়ে আছড়ে মেরেছি।
এই কথা বলে সে চোখ তুলে সোমেনকে লক্ষ করে। কিন্তু তেমন ভ্রূক্ষেপ করে না। বহেরুর খামারবাড়িতে সর্বত্র ভিটামিনের কাজ দেখতে পায় সোমেন। লাউডগার মতো ওই মেয়েটির অস্তিত্বের ভিটামিনও কিছু কম নয়। এ যে বহেরুর মেয়ে তা একনজরেই বোঝা যায়। চোখা নাক, দুরন্ত ঠোঁট, আর চোখ দুটোতে নিষ্ঠুরতা। জ্যান্ত ইঁদুর হাতে ধরে আছড়ে মারা ওর পক্ষে তেমন শক্ত নয়।
সাঁওতাল মেয়েদুটো উঠে দাঁড়িয়েছিল। লম্বাজনের পেট-কেঁচড়ে ইঁদুরের স্তূপ। সোমেন কয়েকপা গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল—খাবে?
অবাক চোখে অচেনা লোকের দিয়ে চায় মেয়েটি। ঘাড় নাড়ল। খাবে।
—কীভাবে খাও? পুড়িয়ে?
সাঁওতাল বলতে যেমন সুঠাম শরীর বোঝায় এ মেয়েটির তা নয়। একটু ঢিলে শরীর, বহু সন্তান ধারণের চিহ্ন, বয়সের মেচেতা, আর ধুলোময়লা-বসা ম্লানভাব। প্রশ্ন শুনে দুধ-সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে—আগে পুড়িয়ে নিই, তারপর কেটেকুটে রাঁধি, যেমন সবাই রাঁধে।
দাঁড়াল না। বহেরুর বাগান এখানে শেষ, ঢালু একটা পায়ে-হাঁটা-পথ মাঠে নেমে গেছে। সেইদিকে নেমে গেল দুজন। সোমেন মুখ ফিরিয়ে বহেরুর মেয়েকে দেখল। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ব্লাউজের হাতা ফেটে হাতের স্বাস্থ্য ফুটে আছে, ডগবগে শরীরে আঁট করে শাড়ি জড়িয়েছে বলে ধারাল শরীর ছোবল তুলে আছে। পিছনে একটি কামিনী ঝোপের চালচিত্র, পায়ের কাছে কলাবতী ফুলের গাছ।
॥ দুই ॥
বহেরুর চার-পাঁচটা মেয়ের সব কজনারই বিয়ে হয়ে গেছে। তার মধ্যে দুজন স্বামীর ঘর করে, একজনের বর ঘরজামাই, আর দুটো মেয়েকে তাদের স্বামী নেয় না। এ সবই সোমেন জানে। এ মেয়েটা ফেরতদের একজন, বিন্দু। বহেরুর কাছ থেকে ধানের দাম বুঝে নিতে কয়েকবার এসেছে সোমেন। তখন এইসব মেয়েরা ছোট ছিল। ধুলোময়লা মাখা গেঁয়ো গরিব চেহারা। ভিটামিনের প্রভাবে লকলকিয়ে উঠেছে। সিঁথিতে সিঁদুর আছে এখনও। বাকি সিঁদুর, অস্পষ্ট।
মেয়েটা সোমেনকে দেখে একটু ইতস্তত করে। সর্দি হয়েছে বোধ হয়, বাঁ হাতে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা কালোজিরের পুঁটুলি। সেটা তুলে বারকয় শুঁকল। অন্যদিকে চেয়ে বলে— আপনার চা হচ্ছে। ঘরে দিয়ে আসব?
—চা?
—খাবেন না? আপনার জন্যই হচ্ছে।
—দিতে পারো।
—অতদূর নিয়ে যেতে ঠান্ডা মেরে যাবে। আমাদের ঘরে আসুন না, বসবেন।
সোমেন মাথা নাড়ে। একা ঘরে মন টেকে না। এদের ঘরে দু-দণ্ড বসা যেতে পারে। আগেও এসেছে সোমেন, গন্ধ বিশ্বেসের কাছে কত গল্প শুনেছে বসে। বহুকাল আর আসা নেই বলে একটু নতুন নতুন লাগে। বহেরুর তখন এত জ্ঞাতিগুষ্টি ছিল না। একা-বোকা হেলে-চাষা গোছের ছিল তখন। এখন তার উন্নতির সংবাদ ছড়িয়ে গেছে চারধারে। নিষ্কর্মা, ভবঘুরে আত্মীয়রা এসে জুটেছে। সংসার বেড়ে গেছে অনেক। বহেরুও বোধ হয় তাই চায়। ভবিষ্যতের বহেরু গাঁয়ে থাকবে তারই রক্তের মানুষ সব।
পুরো চত্বরটাই বহেরুর বসত, তবু তার মধ্যেও ঘের-বেড়া দিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ির মতো বন্দোবস্ত। কামিনী ঝোপটা ডান হাতে ফেলে ধান-সেদ্ধ-করার গন্ধে ভরা একখানা উঠোনে চলে আসে সোমেন, মেয়েটির পিছু পিছু। জিজ্ঞেস করে—গন্ধ বিশ্বেস নেই?
মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, চোখ ছোট করে বলে—থাকে। তবে পাগলমানুষ।
—কোথায় সে? তার কাছে কত গল্প শুনেছি!
মেয়েটা হাসে—এখনও গল্প বলে। সব আগডুম বাগডুম গল্প। ওই বসে আছে।
হাত তুলে বড় উঠোনের একটা প্রান্ত দেখিয়ে দিল।
কটকটে রোদে সাদা মাটির উঠোনটা ঝলসাচ্ছে। চাটাই পাতা, ধান শুকোচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। তারই একপ্রান্তে বসে আছে বুড়ো-সুড়ো এক মানুষ। বহেরু গাঁয়ে মানুষের আয়ুর যেন শেষ নেই। গন্ধ বিশ্বেস মরে গেছে বুঝি। যখন দাদা বা বাবার সঙ্গে এক-আধদিনের জন্য আসত সোমেন তখন সে হাফপ্যান্ট পরে, গন্ধ বিশ্বেস তখনই ছিল বুড়ো। এক সময়ে ডাকাবুকো শিকারি ছিল, সাহেবদের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরেছে কম নয়। গারো পাহাড়, সিলেট, চাটগাঁ—কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করেছে। সে সব জায়গার গল্প করত সোমেনের কাছে। উসকে দেওয়ার দরকার হত না, নিজে থেকেই বলত। কবেকার কথা সব। সোমেনের মনে হত, বুঝি বা ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে গন্ধ। এখনও সেই লোকটা বসে কাক শালিক তাড়িয়ে ধান বাঁচাচ্ছে। হাতে একটা তলতা বাঁশের লগি। আশপাশে গোটা চোদ্দো-পনেরো সাদা সাদা বেড়াল তুলোর পুঁটলির মতো পড়ে রোদ পোয়াচ্ছে। তিন-চারটে দিশি কুকুরও রয়েছে বেড়ালদের গা ঘেঁষে বসে। পাশে একটা শূন্য কলাই-করা বাটি। মুড়ি খেয়েছিল বোধ হয়।
নাম গন্ধ, পদবি বিশ্বাস। কিন্তু সবাই বরাবর ডেকে এসেছে ‘গন্ধ বিশ্বেস’ বলে, যেন বা নামটা ওর পদবিরই অঙ্গ। শোনা যায়, বুড়ো বয়সে একটা ছুঁড়িকে বিয়ে করে এনেছিল! সে গন্ধর সঙ্গে থাকতে চাইত না। কারণ, গন্ধর বিছানায় বিড়ালের মুত, কুকুরের লোম, বালিশে নাল শুকিয়ে দুর্গন্ধ। কিন্তু বউয়ের মনস্তুষ্টির জন্য কিছু ছাড়ান-কাটান দেবে, এমন মানুষ গন্ধ নয়। বউ তাই এক রাতে সরাসরি গিয়ে দেওর বহেরুর দরজায় ধাক্কা দিল—শুতে দাও দিকিনি বাপু। না ঘুমিয়ে গতর কালি হয়ে গেল। সেই থেকে সে হয়ে গেল বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ।