বলতে কী, বাবার চেহারাটা ভুলেও গেছে সোমেন। দেখা হলে হয়তো চট করে চিনতেই পারবে না। সোমেনের জামার বুকপকেটে বাবাকে লেখা মার একটা ছোট্ট চিরকুট আছে। তাতে লেখা—তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি। আমাকেও কিছু দিলে না তুমি। তোমার ইন্সিওরেন্সের পলিসিটা পেকেছে। আমার ইচ্ছা, ওই দশ হাজার টাকায় এখানে একটু জমি কিনি, আমাকে না দাও, রণেনকে অন্তত দাও। ভাড়া বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। ইতি প্রণতা ননী।
বোধ হয় বাবাকে লেখা মার এই প্রথম চিঠি। শেষ বয়সে। খোলা চিঠি, পড়তে কোনও বাধা নেই। আদর ভালবাসার কোনও কথা না থাক, তবু কেমন চমকে উঠতে হয় ‘প্রণতা ননী’ কথাটা দেখে। ‘প্রণতা’ কথাটাকে বড় আন্তরিক বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সোমেনের। এই চিরকুটটা বাবার হাতে দিতে সোমেনের বড় লজ্জা করবে। আবার একটু ভালও লাগবে। ভাল লাগবে ওই ‘প্রণতা’ টুকুর জন্য। লজ্জা করবে টাকার প্রসঙ্গ আছে বলে। বাবা প্রভিডেন্ড ফান্ডের এক পয়সাও কাউকে দেয়নি। ইন্সিওরেন্সের টাকাটা কি দেবে? দাদাও আপত্তি করেছিল। কিন্তু মা শুনল না। বলল—আমাকে যখন নমিনি’ করেছে তখন ও টাকা আমাদেরই প্রাপ্য, কোনওদিন তো কিছু দেয়নি। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাটা বহেরুই পাবে শেষ পর্যন্ত, তোরা বাপেরটা কিচ্ছু পাবি না। বাপের সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ও পাগলের কাছ থেকে টাকা নিলেই মঙ্গল। নইলে পাঁচ ভূতে লুটে খাবে।
তাই মার চিঠি নিয়ে আসা সোমেনের।
টেবিলের ওপর কাগজপত্র পড়ে আছে, একটা স্বর্ণসিন্দুর খাওয়ার খল-নুড়ি, একটা দশবাতির ল্যাম্প, কিছু চিঠিপত্র, একটা সস্তা টাইমপিস টক টক বিকট শব্দ করে চলছে। চিঠিপত্রগুলো একটু ঘেঁটে দেখল সোমেন। কলকাতার কয়েকটা নার্সারির চিঠির সঙ্গে তাদের দেওয়া চিঠিও আছে। আর আছে আজেবাজে ক্যাটালগ, ক্যাশমেমো, কয়েকটা একসারসাইজ বুকের পৃষ্ঠায় সাঁটা কিছু গাছের পাতা, পাশে নামগোত্র লেখা। পুরনো মোটা একটা বাঁধানো খাতা। তার পাতা খুলে দেখল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা—ডায়েরি। তার পরের পৃষ্ঠায় লেখা—পতিত জমিটায় ভেষজ লাগাইব। তার পরের পৃষ্ঠাগুলিতে পর পর কুলেখাড়া, ঘৃতকুমারী, কালমেঘ ও পুরাতন চালকুমড়ার গুণাগুণ। একটা পৃষ্ঠায় লেখা—‘বুড়োনিমের শিকড় হইতে ন্যাবার ওষুধ হইতে পারে, ফকির সাহেব বলেছেন। তার পরেই লেখা—‘তাণ্ডবস্তোত্র জপ করিলে অ্যাজমা সারে।’ অন্য এক পৃষ্ঠায়—‘ইজরায়েলের এক জ্যোতিষী বলিয়াছেন অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী শাসন করিবে কিছু শুভ্রবসন পরিহিত, দণ্ডধারী যোগীপুরুষ।’
এরকম কথা সর্বত্র। বোঝা যায়, বাবা কৃষি, ডাক্তারি, জ্যোতিষী, অকাল্ট ইত্যাদি সব কিছুরই চর্চা করে। ছেলেমানুষি ডায়েরির কোনও একটা পৃষ্ঠায় চিঠিটা গুঁজে রাখবে বলে শেষদিকের পাতা ওলটাতেই সোমেন দেখে একটা প্রায় সাদা পৃষ্ঠা। ঠিক তার মাঝখানে গোটা অক্ষরে লেখা—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে ভাবে একটু। ঘরভরতি একটি আবছায়ার চৌখুপি। সোঁদা গন্ধ। হঠাৎ ওই গন্ধ আর ওই অন্ধকারটা সোমেনকে চেপে ধরতে থাকে। দমফোট লাগে তার।
বাইরের রোদে এসে সে বুকভরে শ্বাস নেয়। কী সবুজ, কী ধারাল রং প্রকৃতির। কী নিস্তব্ধতা। দিগম্বরের খোলের আওয়াজ এখন আর নেই। দূরে পাম্পসেটটা অবিরল চলেছে।
এইখানে মানুষেরা বেশ আছে। মটর শাকের ক্ষেত পার হতে হতে এই বোধ লাভ করে সোমেন। বড় বড় শুঁটি ঝুলে আছে। একটা-দুটো তুলে দানা বের করে মুখে দেয় সে। মিষ্টি। ভুরভুরে বেলেমাটির একটা ক্ষেত তছনছ হয়ে আছে। আলু ছিল বোধ হয়, উঠে গেছে। মাচানের পর মাচান চলেছে, ধুঁদুল, সিম, বিন! যেন বা কেউ শালিমারের সবুজ এনামেল রঙে গাঢ় পোঁচ দিয়ে গেছে চারধারে। হাতের মুঠোয় ধরা যায় না, বিশাল বড় গাঁদা ফুল জঙ্গলের মতো একটা জায়গাকে গাঢ় হলুদ করে রেখেছে।
মহানিমের তলায় বসে আছে দিগম্বর। গাছের গুঁড়িতে ঠেস। মাথা বুকের দিকে ঝুলে পড়েছে। ঘুম। পাশে বশংবদ খোল। রঙিন সুতোর জাল দিয়ে খোলের গায়ে জামা পরানো হয়েছে। লাল-সাদা পুঁতির গয়না খোলের গায়ে। কয়েকটা গাঁদা ফুল গোঁজা আছে। দিগম্বরের নত মুখ থেকে সুতোর মতো লালা ঝুলে আছে।
শীতের মিঠে রোদ পড়ে আছে গায়ে। ঘুম থেকে উঠে আবার বাজাবে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া।
আমের বোল এসে গেছে। পোকামাকড় ঝেঁপে ধরেছে গাছটাকে। ঝনঝন শব্দ বাজছে। একটা দোচালার নীচে একপাল বাচ্চা বসেছে বইখাতা শেলেট নিয়ে। বুড়োমতো একজন পড়াচ্ছে। পোড়োরা তাকে ছোট ছোট বেলের মতো মাথা ঘুরিয়ে দেখল। সোমেন জায়গাটা পার হয়ে আসে। কুলগাছের তলায় দুটো সাঁওতাল মেয়ে বসে আছে। জায়গাটায় ম ম করছে পাকা কুলের গন্ধ। একটা মেয়ে মুখ থেকে একটা সাদা বিচি ফুড়ুক করে ছুঁড়ে দিল, আর একটা কুল মুখে পুরল। বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষের মেজো মেয়েটাকে কাল রাতে একঝলক দেখেছিল। তখন গায়ে ছিল একটা খদ্দরের চাদর। গোলপানা মুখ, শ্যামলা রং, বেশ লম্বা, এছাড়া বেশি কিছু বোঝা যায়নি। সৌন্দর্য ছিল তার চোখে। বিশাল চোখ, মণিদুটো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত অনেক সময় নিয়ে ঢলে পড়ে। দশবাতির আলোয় চোখ থেকে এক কণা আগুন ঠিকরে এসেছিল সোমেনের হৃৎপিণ্ডে। সেই মেয়েটিকে এই সকালের রোদে আবার দেখা গেল। গায়ে চাদর নেই। সতেজ লাউডগার মতো লম্বাটে শরীর। একটা ঝুড়ি বয়ে এনে উপুড় করে দিল সাঁওতাল মেয়েদুটোর একটার কোঁচড়ে।