সোমেনরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে বাবা বাড়ি ফিরলেই মার সঙ্গে ঝগড়া লাগে। প্রথম প্রথম সে ঝগড়ার মধ্যে মান-অভিমান ছিল। মানভঞ্জনও তারা লুকিয়ে দেখে হেসে কুটিপাটি হয়েছে। বাবা মার পায়ে মাথা কুটেছে, আর মা খুশিয়ালি মুখে ভয়-পাওয়া-ভাব ফুটিয়ে বলছে, পায়ে হাত দিয়ে আমায় পাপের তলায় ফেলছ, আমি যে কুষ্ঠ হয়ে মরব! কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেছে ঝগড়ার রকম পালটাচ্ছে। তখন দাদু বেঁচে নেই, দেশ ভাগ হয়েছে। অপদার্থ বাবা কোনওখানে জমি দখল করতে পারল না। ভাড়াটে বাড়িতে সংসার পেতেছে। তবু ধাত পালটায়নি। দু-তিনরকমের চাকরি করেছে বাবা সে সময়ে। প্রথমে ভলান্টিয়ার, তারপর রেশনের দোকান, কাপড়ের ব্যাবসা। কোনওটাই সুবিধে হয়নি। তবে প্রচুর লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সূত্রে, সবশেষে বেশি বয়সে একটা সরকারি কেরানিগিরি জুটিয়ে নেয়। কিন্তু বার-ছুট নেশা ছিল সমান। সোমেন মনে করতে পারে, তারা শিশু বয়সে দেখেছে দিনের পর দিন বাবা বাড়ি নেই। বনগাঁ থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বাবা যেত উদ্বাস্তুদের তদারক করতে কিংবা কোনও মচ্ছবের ব্যবস্থায়, সংকীর্তনের দলে। কোনওটাই কাজের কাজ নয়। বাড়িতে মা আর চারটি শিশু-সন্তান একা। তখন মা আর বাবার ঝগড়ায় মান-অভিমান মরে যেতে লাগল। এল গালাগালি। মা বলত শয়তান, বেইমান, বাবা বলত নিমকহারাম, ছোটলোক। তখন বাবা বাড়িতে না এলেই তারা ভাল থাকে। পরস্পরের প্রতি আক্রোশ দেখে তাদের মনে হত, মা-বাবার এবার মারামারি লাগবে। মারামারি লাগত না। কিন্তু বাবা আরও বারমুখে হয়ে যেতে লাগল। পাঁচজনে বলত, ব্রজগোপালের মতো সচ্চরিত্র লোক হয় না, অমন নিরীহ আর মহৎ দেখা যায় না। সোমেনরাও সেটা অবিশ্বাস করত না। বাইরে লোকটা তাই ছিল। নেশাভাঙ বা মেয়েমানুষের দোষ নেই, ঝগড়া কাজিয়া মেটায়, পাঁচজনের দায়ে-দফায় গিয়ে পড়ে। অমায়িক, মিষ্টভাষী, অক্রোধী। তাকে ভালবাসে না এমন লোক নেই। মা ছিল একটিমাত্র মানুষ যার সংস্পর্শে এলেই বাবার চেহারা যেত পালটে। এবং ভাইস ভার্সা।
বড় হয়ে তারা ভাই-বোনেরা বাবা-মায়ের স্থায়ী ঝগড়াটা মিটিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা কিংবা মা আলাদাভাবে কেউই লোক খারাপ ছিল না। দাদা একবার মা-বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে বুড়ো বয়সে লেট হানিমুন করতে পাঠালে পুরীতে। বিশ্বাস ছিল, সমুদ্রের বিশাল বিস্তারের সামনে, আর তীর্থের গুণে যদি দুজনের মধ্যে একটা টান জন্মায়। কিন্তু মা বাবা খড়্গপুর পার হতে পারেনি। সেখান থেকে ফিরতি ট্রেনে দুই আলাদা কামরায় চড়ে দুজনে ফিরে এল। বাসায় ফিরল আলাদা ট্যাক্সিতে। কথা বন্ধ।
বাবা রিটায়ার করার পর অবস্থা উঠল চরমে। তখন বাবা কিছু বেশি সময় বাসায় থাকত। তখন ঝগড়াটা দাঁড়াল, মা বাবাকে বলত, তুমি মরো, বাবা মাকে বলত—আমি মরলে বুঝবে, দুনিয়াটা হাতের মোয়া নয়। লজ্জার কথা এই, ততদিনে দাদার বউ এসেছে, তাদের ছেলেপুলে হয়েছে। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, জামাইরা আসাযাওয়া করে। তখন মা-বাবা দুজনেই ছেলেমেয়েদের নিজের নিজের দিকে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে। বুড়ো বয়সের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় সবচেয়ে বড় দরকার হয় সাবালক ছেলেমেয়েদের সমর্থন। মার পাল্লাই ছিল ভারী। বাবা অভিমানে বাড়ি ছাড়ল। বাবার বাড়ি ছাড়াটা তখন নিতান্তই প্রয়োজন।
একথা সত্যি যে, একমাত্র দাদা ছাড়া বাবার প্রতি তাদের আর কোনও ভাইবোনেরই তেমন টান নেই। ছেলেবেলা থেকেই তারা মাকে জানে। বাবার সঙ্গ তারা কদাচিৎ পেয়েছে। কাজেই, বাবা বাড়ি ছাড়ায় কেউ তেমন দুঃখ পায়নি। দাদাও না।
বাবা লোকটা বাউণ্ডুলে হলেও তার একটা খুব বড় শখ ছিল। জমি। দেশ গাঁয়ের লোকের জমির টান থাকেই। বাবার কিছু বেশি ছিল। মার গায়ের কিছু গয়না বেচে বহেরুর হাতে দিয়েছিল সেই দেশ ভাগাভাগির কিছু পরেই। বহেরু মার নামে ছ’বিঘে চাষের জমি কিনেছিল। আর নিজের খামারবাড়ির পাশে একটু বাস্তুজমিও। সেই জমিটা তারের বেড়ায় ঘেরা হয়ে পড়ে আছে। রিটায়ারমেন্টের সময়ে বাবা প্রায়ই ছেলেমেয়েদের এবং মাকেও বলত গোবিন্দপুরে বাড়ি করে সকলে মিলে থাকার কথা। কিন্তু ততদিনে তার ছেলেরা কলকাতার জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছে। কেউ এল না। বাবা গৃহত্যাগ করে এল একা। মাঝে মাঝে যায়। দু’মাসে ছ’মাসে একবার। চিঠিপত্র দেয় মাঝে মাঝে। দাদা কয়েকবার দেখা করে গেছে। কেউ এলে বাবা অভিমান করে রাগ করে বলে—কেন এসেছ? আমি বেশ আছি।
সোমেন জানে, সংসারের প্রতি, পরিবারের প্রতি বাবার কোনও টান আর নেই। তারাও বাবার কথা ভাবে না বড় একটা। আর পাঁচজন নিষ্পর লোকের মতো বাবাও একজন। কোনও টান ভালবাসা, দেখার ইচ্ছে কখনও বোধ করেনি সোমেন। গত পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে সে বাবাকে দেখেছে এক-আধবার। বুড়ো মতো, টান-টান চেহারার একজন গ্রাম্য লোক, ঢোলহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা, সদর থেকে বউদি বা দাদার ছেলেমেয়ে, কিংবা ঝি-চাকরের কাছে বাড়ির লোকের কুশল জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকত না, বাড়ির জলটলও খেত না। কিন্তু ফিরে আসবার সময় সিঁড়ি ভাঙত আস্তে আস্তে। দু-একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাত। জোরে গলা খাঁকারি দিত। এ দৃশ্য সোমেন নিজেই দেখেছে। কিন্তু কাচালে বুড়োর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি।