আপনিই তো বাজালেন।
বুড়ো থরথরিয়ে কেঁপে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে সোমেনের হাত দুটো সাপটে ধরে ককিয়ে ওঠে—আমি না বাবু, আমি না। গুরু বাজাইছে। মাঝেমইধ্যে গুরু ভর করে শরীলে…
কথার টান শুনে বোঝা যায় দিগম্বর ঢাকা বা ওদিককার পুব দেশের লোক। যশোর বা খুলনার নয়। তবু কেন যে তাকে জ্ঞাতি বা খুড়ো বলে চালাচ্ছে বহেরু তা কে জানে! সোমেন শুনেছে, বহেরু নানা জায়গার সব গুণী, কিম্ভূত বা অস্বাভাবিক লোক এনে তার নিজের কাছে রাখে। এটাই ওর বাতিক। কী পরিষ্কার টনটনে আওয়াজে ওই খোল বাজছে এখন। কী একটা কথা ফুটি-ফুটি হয়ে উঠছে। ঠিক বোঝা যায় না। আবার বোঝাও যায়। বহেরুর বিশাল সংসারের নানা বিষয়কর্মের শব্দ উঠছে। কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ, পাম্পসেটের আওয়াজ, শিশুদের চিৎকার, বাসনের শব্দ। কিন্তু সব শব্দের ওপরে খোলের আওয়াজ বধির করে দিচ্ছে পৃথিবীকে।
হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে আছে কাঁটাঝোপের বেড়া। সোনা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার পাশে বহেরু দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শোনে একটু। তারপর হঠাৎ ফিরে বলে—খুলোমশাইয়ের খোল কি বলছে বুঝছেন?
সোমেন অবাক হয়ে বলে—না তো! কী?
—ভাল করে শুনুন।
সোমেন শোনে। বলছে বটে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায় না।
বহেরুর বিযয়ী চোখ দুটো হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তাতে একটা বৈরাগ্যও এসে যায় বুঝি। মাথা নেড়ে বলে—ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া…
হাসে বহেরু।
কিন্তু সোমেন আবাক হয়ে শোনে। সত্যিই পরিষ্কার ভাষাটা বুঝতে পারে সে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…
আবার পালটে যায় বোল। বহেরু হাঁটতে হাঁটতে বলে—এখন বলছে চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন…. পরমুহূর্তেই আবার পালটে যায় বোল। বাঙ্ময় খোলে বহেরুর খুড়ো আর একটা কী কথা বলে যেতে থাকে।
বহেরু হাঁটতে হাঁটতে ধুঁধুল লতায় অন্ধকার শুঁড়িপথ ধরে বলে—এবার বলছে মাখিজুখি, মাখিজুখি, মাখিজুখি…
দু-তিনটে সনের শব্দ ওঠে। খোল বোল পালটাচ্ছে।
বহেরু শ্বাস ছেড়ে বলে, শুনুন, বলছে—দে দই, দে দই, দে দই…
সোমেন দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর হাঁটে আবার। খোল ততক্ষণে ফিরে ধরেছে প্রথম বোল৷ ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…
একটু হতাশায় ম্লান হাসি হেসে বহেরু মাথা নেড়ে বলে—সারাদিনই শুনবেন ওই আওয়াজ। যান আপনি বিশ্রাম করেন।
মটরশাকের ক্ষেতে সাদা ফুল প্রজাপতির মতো আলগোছে ফুটে আছে। বহেরু যখন ক্ষেতটা পার হচ্ছে, তখন গাছগুলি শুঁড় বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে চাইছে, এই দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখল সোমেন।
বিশ্রাম করার কিছু ছিল না। বহেরু বয়স্ক লোক, তার ওপর দেশের মানুষ। সিগারেটটা এতক্ষণ ইচ্ছে করেই খায়নি সে। একটা সিগারেট খাবে বলে ঘরে ঢুকল। বাবার ঘর। এই ঘরটায় রাত কাটিয়েছে সোমেন। বড় কষ্ট গেছে।
সরগাছের বেড়ার ওপর মাটি লেপা, ওপরে টিনের চাল। সারা রাত ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকেছে, আর শব্দ উঠেছে টিনের চালে। একধারে বাঁশের মাচানে বিছানা। গদির বদলে চটের ভিতরে খড় ভরে গদি বানানো হয়েছে, তার ওপর শতরঞ্জি আর পাতলা তোশকের বিছানা। গায়ে দেওয়ার জন্য একটা মোটা কাঁথা। একটা শক্ত বালিশ।
একটা হলদি কাঠের সেলফে কিছু কাচের জার, শিশি, বোতল। কৃষি বিজ্ঞানের কয়েকটা বই। একটা ছোট টেবিল, লোহার চেয়ার। দুটো ঝাঁপের জানালা খুলে আলো হাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। তবু ঘরটা আবছা। দীর্ঘ বৃষ্টির দিনে যেমন ঘরের আসবাবে, বিছানায় একটা সোঁদা গন্ধ জমে ওঠে, এ ঘরে তেমনই এক গন্ধ। মাটির মেঝেয় ইঁদুরের গর্ত, বাঁশের খুঁটির নীচে ঘুণপোকায় কাটা বাঁশের গুঁড়ো। উইয়ের লাইন গেছে কাঠের তক্তার পাটাতন পর্যন্ত। বাবার বউল-ওলা খড়ম জোড়া আর একটা পিতলের গাড়ু মাচানের নীচে। তার পাশে বড় একটা টিনের, আর একটা চামড়ার স্যুটকেশ। দুটোই বিবর্ণ। মশারিটা চালি করে রেখে গেছে কে, ঘরটা ঝাঁটপাটও দিয়েছে, কিন্তু কিছুমাত্র উজ্জ্বলতা ফোটেনি। এই ঘরে তার বাবা থাকে। দিনের পর দিন। এবং প্রায় অকারণে। ভাবতে, বহুকাল বাদে বাবার জন্য একটু করুণা বোধ করে সোমেন।
চেয়ারটায় বসতেই টিনের চেয়ারের কনকনে ঠান্ডা শরীরের নানা জায়গায় ছ্যাঁকা দেয়। তবু বসে থাকে সোমেন। একটা সিগারেট ধরায়।
গত এক মাসে বাবাকে দুটো চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটারও জবাব পায়নি। বাবা চিঠি দেবে না, এ তাদের জানাই ছিল। কিছু লোক থাকে যারা ঘর-জ্বালানি কিন্তু পর-ভুলানি। নিম্পর লোকেরা নাম শুনলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলে সাক্ষাৎ দেবতা। অমন পরোপকারী মানুষ হয় না। কিন্তু ঘরের লোক জানে, ওরকম খেয়ালি, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মানুষ আর নেই। এরকমই একজন ঘরজ্বালানি লোক হচ্ছে বাবা, যাকে বাড়ির লোক বাদে আর সবাই সম্মান করে। পরোপকারী? হবেও বা। বাবার খুব বেশি রহস্য জানা নেই সোমেনের। সে মার কাছে শুনেছে, ভরা যৌবনে স্ত্রীকে রাতে-বিরেতে পাড়াপড়শির ভরসায় ফেলে রেখে বাবা যাত্রা-থিয়েটারে যেত। যাত্রা-থিয়েটারে পার্টও করত না, দেখতেও যেত না। যেত, স্টেজ বাঁধতে যাত্রাদলের সুখসুবিধের ব্যবস্থা করতে। ফুটবল খেলতে না জানলেও গাঁয়ের ম্যাচ-এ বাবা ছিল প্রধান জোগাড়ে মানুষ। গ্রাম দেশে প্রথা আছে, গোলপোস্টের পিছনে একজন কোনও নিষ্কর্মাকে গোলজাজ হিসেবে বসিয়ে দেওয়ার। বাবার কোনও যোগ্যতা ছিল না বলে ‘গোলজাজ’ হত বরাবর। এরকম কোনওখানে কিছু একটা হচ্ছে জানলেই সেখানে ছুটে যেত মহা ব্যস্ততায়, দরকার থাক না থাক, সামান্য যে কোনও দায়িত্ব নিয়ে সাংঘাতিক ডাক হাঁক পাড়ত। পাড়াপড়শিদের ফাইফরমাশ খাটত বিনা দ্বিধায়। আশপাশের বিশ গাঁয়ের লোকের কাছে ব্রজগোপাল ছিল অপরিহার্য লোক। ব্রিজ খেলার কারও পার্টনার না জুটলে ব্রজগোপাল তিনক্রোশ বর্ষার গেঁয়ো রাস্তা ঠেঙিয়ে যেত। খেলতে পারত না তেমন, ভুলভাল ডাক দিত। পার্টনার রাগারাগি করলে অমায়িক হাসত। সবাই জানে, এমন নিরীহ লোক হয় না। কিন্তু বাড়িতে সে লোকের অন্য চেহারা। পুরুষ সিংহ যাকে বলে। সোমেনরা মার কাছে শুনেছে, বারোটা রাতে দেড়সের মাংস আর তিনজন উটকো অতিথি জুটিয়ে এনে মাকে দিয়ে সেই রাতেই রাঁধিয়ে ভোর রাতে খেয়ে বিছানায় গেছে। তিথি-না-মানা অতিথির জ্বালায় মা অতিষ্ঠ, বাড়ির লোকজন জ্বালাতন। সারা যৌবন বয়সটা বাবাকে রোজগার করতে কেউ দেখেনি। দাদুর জমিজিরেত আর সেরেস্তার চাকরির আয়ে সংসার চলত। নেশাভাঙ ছিল না বটে, কিন্তু বাড়ির জিনিসপত্র, এমনকী নিজের বিয়ের শাল, আংটি, ঘড়ি পরকে বিলিয়ে দিতে বাধেনি।