রিখিয়ার কান্না সামলে নিলেন ননীবালা। তারপর গোপনে, চুরি করে বউকে লেখা। ছেলের চিঠি পড়লেন দুপুরে। একটা গভীর শ্বাস ফেলে আপনমনে বললেন—বউটাকে কষ্ট দেবে, আগেই জানি। হুবহু বাপের মতো হল কেন যে ছেলেটা!
তারপর ননীবালা রিখিয়াকে স্বামী বশ করার নানা কৌশল শেখাতে থাকেন। কত উপদেশ দেন। সোমেনের স্বভাবের নানা কথা শতখান করে বোঝাতে থাকেন। তাঁর প্রাণে বড় ভয় এই ছেলেটাকে নিয়ে। যত বড় হচ্ছে তত ওর মধ্যে বাপের অবশ্যম্ভাবী প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে।
রিখিয়া সোমেনকে লেখে—শোননা, আমার সত্যিকারের আপনজন কেউ কখনও ছিল না। জন্মের পর থেকে আমি একা। একা একা খেলতাম, ঘুমোতাম, গান গাইতাম। তেমন আদর পাইনি কারো। বিছানায়, বাবা বাইরে, দাদা নিজের পড়াশুনা খেলা আর বন্ধু নিয়ে ব্যস্ত। ভেবেছিলাম, বিয়ে করলে বুঝি এই অসহ্য একাকীত্ব কাটবে। তা বুঝি হল না আমার। তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? কেন তুমি আমাকে বোঝো না একটুও পাগল?…পুজোয় না এলে বিষ খাব…
সোমেন আবার দাড়ি রেখেছে। চুল বড় হয়েছে। গায়ের রঙে চাষাভুষোর মতো কালো। কিন্তু চেহারাটা অনেক শক্তপোক্ত হয়েছে তার। মেদহীন রুক্ষ পৌরুষের চেহারা। মুখে একটু লজ্জার হাসি নিয়ে পঞ্চমীর দিন এসে গোবিন্দপুরে পৌছল ননীবালা আর রিখিয়া ঢেউ। হয়ে এখানে-সেখানে ধেয়ে যাচ্ছেন আয়োজন করতে।
নির্জনে পেয়ে সোমেন রিখিয়াকে বলে—আর কখনও বিষ খাওয়ার কথা লিখবে?
অকপটে রিখিয়া তাকিয়ে থেকে বলে—কেন আসবে না লিখেছিলে?
—বড় লজ্জা যে!
—ছিঃ। ওরকম আর ভেব না। আমি কিন্তু অনেকবার বিষ খাওয়ার কথা ভেবেছি। জীবনে। সেটা মনে রেখো।
—কেন ভেবেছ?
—একা থাকা অসহ্য লাগত যে!
—আর ভেব না।
—আমাকে একবার তোমার ওখানে নিয়ে যাবে না।
সোমেন হেসে বলে—হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছ কতদিন হয়ে গেল, কলেজে ভরতি হলে না যে বড়? ভেবেছ কী?
—কী হবে আর পড়ে? আমার ভাল লাগে না। শ্বশুরমশাই বলেছেন, আমি যেন কখনও চাকরি-টাকরি না করি।
—চাকরি না করলে। কলেজ ভরতি হয়ে যাও।
রিখিয়া মাথা নেড়ে বলল—আচ্ছা।
—লেখাপড়া অনেক কাজে লাগে।
—তা হলে তুমিও এম এ পরীক্ষা দাও।
—দেব।
দুজনে হাসে।
অবসর সময়ে সোমেন তার বাবার সব পুঁথিপত্র খুলে বসে হাঁটকায়। বাবার অনেক | লেখাপত্র আছে। টীকা, ভাষ্য, ব্যাখ্যা। সেসব খুলে পড়ে। ব্রজগোপাল যখন বাসায় থাকেন তখন নিবিষ্ট হয়ে বসে বাবার সঙ্গে সমাজ সংসারের হাজারো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। ব্রজগোপালের মুখ চোখ দীপ্ত হয়ে ওঠে। বলেন—সারাটা জীবন এইটুকুর অপেক্ষায় থেকেছি বাবা। আমার কুড়োবামুনের কথা যদি আমার ছেলেদের কেউ কখনও জানতে চায়। তবে শোননা…
অবিরল বোঝাতে থাকেন ব্রজগোপাল। সোমেন শোনে।
তারপর একদিন বাপের ছায়ার মতো বেরিয়ে পড়ে সোমেন। ব্রজগোপালের সঙ্গে যজমানদের বাড়ি বাড়ি ফেরে। যাজন শোনে, নানা সমাবেশে যায়। ব্রজগোপালের পরিচিতির বহর দেখে বড় অবাক মানে সে। চাষাভুষো থেকে সমাজের সবচেয়ে উঁচুতলার লোক সবাইকেই চেনেন বাবা। সবাই বাবাকে চেনে এক ডাকে। ব্রজগোপাল হাত পাতলে একবেলায় চার-পাঁচহাজার টাকার দান উঠে আসে।
রহস্যটা সোমেনকে জানতেই হবে।
॥ উনআশি ॥
এসব দেখে ননীবালা বড় হতাশ হন।
রিখিয়াকে বলেন—ও বউ, আমার ছেলেকে সামলিও। এ আমি ভাল বুঝছি না। বাপের রোগ।
রিখিয়া অবাক চোখে তাকায় ননীবালার দিকে। বলে—কীসের রোগ মা?
—পরভুলানি রোগ মা। ওরা সংসারের কেউ নয়, ওরা সব বিশ্বসংসারের জন্য জন্মেছে।
রিখিয়ার একরকমের লাজুক, মিষ্টি হাসি আছে। মাথা নেড়ে বলে—আমার বেশ লাগে তে।।
দুহাতে রিখিয়ার মুখখানা তুলে চোখের কাছে এনে ননীবালা নিবিড় দৃষ্টিতে দেখেন। রিখিয়া হেসে ফেলে। গভীর শ্বাস ছেড়ে ননীবালা বলেন—তুমি একটু অন্যরকম। তুমি ঠিক আমাদের মতো নও মা।
—কেমন মা?
—বোধ হয় ভাল। খুব ভাল।
রিখিয়া হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে—অত ভাবো কেন মা? ওকে পথ খুঁজে নিতে দাও। সবাই একরকমের জীবন কাটাবে?
রিখিয়াকে তুমি ডাকতে ননীবালাই শিখিয়েছেন ইদানীং। ‘তুমি’ শুনলে একদম মেয়ের মতো লাগে।
আদর ভালবাসার একটা একটা দলা এল গলায়। এখন কাঁদবেন ননীবালা। তাই রিখিয়াকে ছানার ডালনা রাঁধতে শেখাতে বসেও বললেন—যা তো মেয়ে, ঘরে গিয়ে একটু দুধ খেয়ে আয়।
—না, অত খেতে পারি না।
—যা না। দুটো হাত ধরছি, যা।
রিখিয়া অনিচ্ছায় উঠে যায়।
ননীবালা কাঠের জ্বাল ঠেলে তুললেন। তারপর আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন ঠায়। দুচোখ বেয়ে অবিরল জলের ধারা বুক ভাসিয়ে নেয়।
মশলামাখা দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রাণভরে ঠাকুরকে ডাকেন, বিড়বিড় করে বলেন—ওদের সুখে রেখো ঠাকুর।
তারপর হঠাৎ মনে হল, কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনাল না তো! ব্রজঠাকুরের বামনি কি শুধু নিজের জনের সুখ চাইতে পারে? তাতে ঠাকুর হয়তো বিমুখ হবেন।
তাই আবার প্রাণভয়ে দুহাত জড়ো করে বলেন—ঠাকুর, বিশ্বসংসারের সবাই যেন সুখে থাকে।
***