পরদিন দুপুরে ফিরে যাচ্ছে সোমেন। ব্রজগোপাল রিকশা করে স্টেশন পর্যন্ত এলেন তার। সঙ্গে।
গাড়ি আসবার আগ মুহূর্তে শুধু বললেন—স্থির থেকো।
কথাটা বুঝল না সোমেন।।
গাড়ি এল। গাড়ি ছেড়ে দিল।
যত বড় করে সমস্যাটাকে দেখেছিল সোমেন আসলে তা মোটেই তত বড় ছিল না। সে সমস্যাকেই দেখেছিল, ভেবেছিল রিখিয়াকে বিয়ে করার সব দায়িত্বই বুঝি তার। অবোধ মেয়ে রিখিয়া, সে আর কী করবে?
কলকাতার বাসায় ফিরে এসেই সে পেল শৈলীমাসির চিঠি। লেখা—বাবা সোমেন, রিখি আমাকে সব বলেছে। জানো না তো, সে যা চায় তাই হয়। সে তোমাকে চেয়েছে। আমিও কতদিন তোমার কথা ভেবেছি রিখির জন্য। আমার নিজের ছেলে পর হয়েছে। তুমি পরের ছেলে আপন হও। ননীর কাছে চিঠি লিখেছি। রিখির বাবা তোমার বাবাকে চিঠি দিল আজ। কতদিন দেখি না তোমাকে। শুনলাম, খুব কালো হয়ে গেছ? রবিঠাকুরের মতো দাড়ি রেখেছ, তাও শুনেছি। বিয়ের দিন কিন্তু ওভাবে এস না। তার আগে এস একদিন, তোমার সন্তপুরুষের মতো মুখখানা একবার দেখব। আসবে তো?…
চিঠি পড়ে বউদিকে ডেকে দেখাল সোমেন।।
বীণা একটা চাপা হর্ষের চিৎকার করে ওঠে। সোমেনের দিকে হাঁক করে চেয়ে থেকে বলে—আচ্ছা চালাক ছেলে যা হোক, বড়লোকের মেয়েটাকে ঠিক বেঁধে ফেলেছ।
বাঃ রে, তুমিই তো বললে!
ন। বললে বুঝি ছেড়ে দিতে?
দুদিন পরেই ব্রজগোপাল আর ননীবালা এলেন।
বাড়িতে উৎসবের হাওয়া বয়ে যেতে লাগল।
সুন্দরবন থেকে আর একবার ঘুরে এল সোমেন। শ্রাবণের মাঝামাঝি রিখিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল তার।
বিয়ের পর বউভাতের দিন ভাড়াটে বিয়ে বাড়ির ছাদে তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে অপালা বলল—বিট্রে করলি তো! তোর আশায় ছিলাম ঠিক, এখন মিহির বোস ছাড়া আর কোন শালা বিয়ে করবে আমাকে বল তো!
ভাগ। সোমেন বলে—বিট্রে করেছি বলে দুঃখের তো চিহ্নও দেখলাম না। আট পিস ফিস ফ্রাই খেলি বসে বসে দেখলাম।
এঃ মা, হোস্ট কখনও খাওয়ার খোঁটা দেয় বুঝি! আর কখনও যদি তোর নেমন্তন্ন খাই দেখিস।
আমিও আর বিয়ে করছি না।
অনিল রায় আজ একদম মদ খাননি। হার্ট অ্যাটাকের পর খানও কম। পাইপ ধরিয়ে ঘুর ঘুর করছিলেন চারদিকে। সোমেনকে ডেকে বললেন—বিয়েতে খাওয়ানোর সিস্টেমটা কেন তুলে দিচ্ছ না তোমরা? নিতান্তই যদি না পারো তো বক্স সিস্টেম করো। বাই দি ওয়ে সোমেন, তোমার সেই পুরনো হবিটার কী হবে?
কী হবি স্যার?
সেই যে প্রায়ই একে-ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে।
সোমেন হেসে ফেলে। বলে—হবিটা এখন মিহির বোসকে দিয়ে দিয়েছি স্যার। শুনেছি ও নাকি প্রায়ই একবার অপালাকে আর একবার পূর্বাকে প্রোপোজ করে। দুজনেই কেবল রিফিউজ করছে।।
পূর্বা তেড়ে এসে বলল—ইঃ, আমাকে করুক তো প্রোপোজ।
করেনি তোকে? সোমেন অবাক।
মোটেই না। অত সাহস আছে?
করলে কী করবি?
অনেকদিন বাদে পূর্বা খুব বুদ্ধি করে উত্তর দিল আজ। ফচকে হেসে বলল—মাইরি। রাজি হয়ে যাব।
দারুণ হাসল সবাই। মিহির বোস নিজেও।
অণিমা আসেনি। ওর বাড়ি থেকে গান্ধু আর তার মা এল। প্রায় দুই ভরি ওজনের। সোনার হার দিয়ে গেল। অণিমা পার্সেলে একটা বালুচর শাড়ি পাঠিয়েছে, চিঠিতে। লিখেছে—যাওয়া হল না সোমেন। খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। মেয়েদের যে কত বাধা!
রাতে শুতে গিয়ে আর এক বিপদ। দুই দিদি আর বিস্তর আত্মীয়া পাশের হলঘরে ডেকরেটারের শতরঞ্জিতে চিল্লাচিল্লি করছে। শতবার তারা এসে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে—ও সোমেন, আমাদের বালিশ কম পড়েছে, দরজা খোল। এমনকী ছোড়দি পর্যন্ত এসে দরজার গোড়ায় বসে গান গাইতে থাকে।
সোমেন গিয়ে দরজা হাট করে খুলে দিয়ে বলে—নে বাপু, কোনও সিক্রেসি রইল না আর। এবার একটু ঘুমোতে দে। বড় ধকল গেছে।
বিয়ের পরই সুন্দরবনে ফিরে গেল সোমেন। একা। মনে একটা লজ্জা আর অপরাধবোধ কাজ করে সব সময়ে। ভাবে, ছিঃ, আমি কেন বড়লোকের ঘরে বিয়ে করতে গেলাম! কী। দরকার ছিল? লোকে ভাববে, লোভি সোমেন এইভাবে নিজের প্রবলেম সলভ করে নিল। ভাববে, শ্বশুরের পয়সায় বড়লোক হয়ে গেল সোমেন। ছিঃ ছিঃ, যদি তাই ভাবে?
বড় যন্ত্রণা গেল এদিন। এসব যন্ত্রণার কথা কাকে আর জানাবে। রিখিয়াকেই মস্ত চিঠি লিখল সে।
রিখিয়ার, এখন কোনও স্থায়ী ঠিকানা নেই। বাপের বাড়ি দুদিন থাকল, রণেন এসে নিয়ে। গেল ঢাকুরিয়ায়। ঢাকুরিয়ায় তিনদিন কাটবার আগেই শীলা এসে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে যায়। তার বাড়িতে, চারদিন পাঁচদিন আটকে রাখে। খারাপ লাগে না রিখিয়ার। তার নিলেন। বাড়িতে এত লোক, এত আদর করার মানুষ সে পায়নি কখনও। মা চিরকাল বিছানায়, বা। ব্যস্ত, সংসার ছিল গভর্নেস, আয়া, ঝি আর চাকর দারোয়ানের হাতে। এদের বাড়িতে ল সব নেই। সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগে। বড় ভাল লাগে দিদি, বউদি, দাদা ডাকতে।
ব্রজগোপাল এলেন একদিন। রিখিয়াকে দেখে বললেন—মাগো, চেহারাটা ভাল সেন। এরা বিশ্রাম দিচ্ছে না তোমাকে, ওদিকে তোমার শাশুড়িও তোমার জন্য অস্থির। বাক্সটাক্স গুছিয়ে নাও তো। বেলা তিনটেয় অমৃতযোগ।
বিন্দুমাত্র আপত্তি হয় না রিখিয়ার। ব্রজগোপাল অসম্ভব কর্তব্যপরায়ণ মানুষ, নিজেই বেয়াইবাড়িতে ফোন করে অনুমতি নিয়ে আসেন।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ঠিকানায় লেখা সোমেনের চিঠি রি-ডাইরেক্ট হয়ে গোবিন্দপুরে রিখিয়ার হাতে গেল। চিঠি পড়ে রিখিয়া কেঁদে অস্থির। চিঠির শেষে সোমেন লিখেছে—আমি পুজোর ছুটিতে যাব না। এখন কিছুদিন আমাকে দূরে থাকতে দাও। বিয়ের পর থেকে আমার মন খুব অস্থির।…আরও সব অনেক কথা লিখেছে। বড়লোকের ঘরে। বিয়ে করা গরিবের ছেলের ঠিক হয়নি। আরও কত কী!