একটু ঝুম হয়ে পড়ে থেকে ভাবল সোমেন। তারপর মুখ তুলে মার দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল—তুমি কি ভাবো, আমার মনের জোর নেই?
সে আছে থাক। তা বলে অমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটাকে হাতছাড়া করতে হবে নাকি? এই তো বললি, কথা দিয়েছিস। কথার খেলাপ করবি শেষে? তার চেয়ে ওঁকে না জানানোই ভাল।
সোমেন মাথা নেড়ে বলল—না মা, তা হয় না। আমার বড় অহংকার। কোনও অপমান আমার সহ্য হবে না, তার চেয়ে বিয়ে না হওয়া ভাল। সেইজন্যই আমি বাবার পরামর্শ চাইছি।
ননীবালা পাখাটা ফেলে দিয়ে একটু হতাশ গলায় বললেন—তোর মধ্যে ঠিক তোর। বাবার ছাপ দেখতে পাই। হুবহু। যে-ই তোর বউ হোক সে বড় কষ্ট পাবে।
ব্রজগোপাল এলেন সন্ধে পার করে। সোমেন বেরিয়েছিল বাঁধের দিকে। বহেরুর। খামারবাড়ির অনেক উন্নতি দেখল ঘুরে ঘুরে। গন্ধ বিশ্বেস এখন আর তোক চিনতে পারে ন।। দিগম্বরের খোলের আওয়াজ বড় মৃদু, তাও কচিৎ শোনা যায়। নানা রকমের লোক আমদানি হয়েছে এখানে। একটা কামারশালা বসিয়েছে বহেরু, একজন পুতুলের কারিগরকে জমি দিয়েছে। একটা পাঁচ মন ওজনের পেল্লায় মোটা লোককে কচ্ছপের মতো ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। বিন্দু সেই আগের বারের মতোই সঙ্গে ছিল আজও। বলল—ও লোকটা সত্যিই একটা আস্ত খাসির মাংস খেয়ে নেয় একবারে।
চিড়িয়াখানায় একটা কাকাতুয়া এসেছে নতুন, সাতশো টাকা দাম। একটা হরিণ এসেছে। একটা বনবেড়াল।
বিন্দু বলল—চলে যাচ্ছি।
কোথায়?
আর কোথায়? কোকাদাদা বলে দিয়েছে, বাবা মরলে ঝেটিয়ে তাড়াবে। যা চুলের মুঠি ধরে কিল দেয় কোকাদাদা! এখানে ঠাঁই হচ্ছেনা। তাই সেই ম্যাদামাকা লোকটার বাড়িঘরেই যাব, আর জায়গা কোথায়?
বিন্দুকে খুব দুঃখী মনে হল না। নিজে থেকেই বলল—কেবল নয়নদিদিরই গতি হল না। কিলটা, চড়টা খেয়ে মরবে। আমি তবু পালিয়ে বাঁচব।
সন্ধেবেলা ঘরে ফিরতেই বাবাকে দেখে মনটা কেন যে বেশ ভাল লাগল।
প্রণাম আশীর্বাদ সব হয়ে যাওয়ার পর ব্রজগোপাল হঠাৎ খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন—তোমার মার কছে সব শুনেছি। তোমার সৎসাহস দেখে অবাক হই বাবা, এ যুগে কেউ ভাব ভালবাসার ব্যাপারে বাপ মাকে টানে না, পরামর্শটৰ্শ করে না।
সোমেন মাথা নিচু করে থাকে।
ব্রজগোপাল চৌকিতে সিধে হয়ে বসে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন—ছেলেদের অবশ্য কোনও মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া ঠিক নয়। সেটা পৌরুষের বিরোধী। তোমার মা বলছিলেন, প্রস্তাবটি সেই মেয়েই দিয়েছে।
সোমেন চুপ করে থাকে।
ব্রজগোপাল বলেন—ভাল। সে মেয়েটি কি তোমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে?
কী বলবে সোমেন! ননীবালা বলেন করে না আবার! ওর মধ্যে চরিত্রওলা ছেলে পাবে। কোথায়?
ব্রজগোপাল বললেন—শ্রদ্ধা বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। তোমার সঙ্গে তার বয়সের কত তফাত হচ্ছে হিসেব করেছ?
সোমেন চুপ। ননীবালা বললেন—ন-বছরের মতো। না রে সোমেন?
সোমেন ক্ষীণ মাথা নাড়ে।
আর একটু হলে ভাল হত। বউ ইয়ার বন্ধুর মতো হলে ভাল হয় না। বয়সের তফাত বেশি হলে শ্রদ্ধাটা আপনি আসে।
ননীবালা মাঝখানে পড়ে গেলেন—তোমাদের সব সেকেলে নিয়ম বাপ।
ব্রজগোপাল মৃদু হেসে বলেন—তুমি কবে থেকে আবার মডার্ন হলে?
ননীবালা লজ্জা পেয়ে পানের বাটা নিয়ে বসেন। বলেন—ছেলে ছোকরাদের ব্যাপারে। অত খুঁত ধরলে হয়!
ব্রজগোপাল লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোতে একটু দূর চোখে চেয়ে বলেন—শিক্ষা, দীক্ষা। আর বিয়ে, এ তিন ঠিক না হলে জাতি পতিত হয়ে যায়। বিয়ে কি সোজা কথা! ওই বিয়ে থেকেই বিপ্লবের শুরু।
সোমেন একবার তাকাল বাবার দিকে। চোখ সরিয়ে নিল ফের।
ব্রজগোপাল বলেন—মেয়েটির পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল শুনেছি।
ননীবালাই বললেন—টাকার লেখাজোখা নেই। দেবেথোবে অনেক।
সোমেন রাগত চোখে মার দিকে তাকাল।
ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—কাকে দেবে? তোমার ছেলেরা কাঙাল না কি? বলে একটু চুপ করে থেকে বলেন—ঠাকুর জানেন, আমি কখনও চাইনি যে, আমার ছেলেরা অর্থবান তোক, বরং চিরকাল চাই, ছেলেরা চরিত্রবান হোক, শ্রদ্ধাবান হোক, ধর্মশীল,হোক।
সোমেন বাবার মুখের দিকে তাকায়। এই এক মানুষ, যেমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল হয়ে আসছে ক্রমে।।
ব্রজগোপাল বললেন—অকপটে বলো বাবা, মেয়ের বাড়ির স্বচ্ছলতা তোমাকে আকর্ষণ করেনি তো?
না, না। ছিঃ। সোমেন লজ্জায় মরে গিয়ে নিচু স্বরে বলে।
জেনে রাখলাম। এখন নিশ্চিন্তে এগোতে পারি।
ননীবালা জরদার হেঁচকি তুলে বলেন—না হয় কিছুই চাইব না আমরা। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের কী করবে?
ব্রজগোপাল তেমনি উদাস ভঙ্গিতে বসে থেকে বলেন—বিষয়আশয়ে অনেক তফাত হয়ে যাচ্ছে দুই পরিবারের। ভয় হয় মেয়েটা এত বড় পরিবর্তন সইতে পারবে কিনা। তার মা বাপও যেন খুশি হয়ে মেয়ে দেন তাও আমাদের দেখতে হবে। সবদিক ভেবে দেখা কাজ বড় সোজা নয়।
সোমেনের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব এল। সে হঠাৎ বলল—বাবা, আপনি যা ভাল বুঝবেন, করবেন। আমার কোনও মতামত নেই।
এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ব্রজগোপালের মুখ ভরে গেল। মাথা নেড়ে বললেন—তোমায়। জ্বালাযন্ত্রণা নিয়ে আমার চেয়ে বেশি কেউ ভাববে না। নিশ্চিন্ত থাকো বাবা, তোমার সুখের জন্য, ভালর জন্য যতখানি করা যায় সব আমি দেখব। আমি শুধু বাপের চোখের জগৎ দোৰ। ন।, একটা আদর্শের চোখ দিয়ে দেখি। আমাকে দেখতে হবে, তোমার ভিতর দিয়ে যেন পারিপার্শ্বিকের কল্যাণ আসে। সব ঘটনারই ভাল মন্দ দুটো দিকের জন্যই নিজেকে প্রস্তুত। রেখো। যদি মন্দটা ঘটে তা হলেও ভেঙে পোড়ো না।