শৈলীমাসি ভাববে যে।
কেউ ভাববে না। আমি তো প্রায়ই ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে বা বন্ধুর বাসার যাই।
সে তো গাড়িতে যাও। আজ তো গাড়ি নিয়ে বেরোওনি, ঠিক ভাববে সবাই।
ভাবুকগে। আগে বলো, আমাদের কী হবে!
সোমেনের মুখ শুকিয়ে যায়। বিবেকানন্দ পার্কের পাশে অন্ধকারে একটু দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় সে। ততক্ষণ ভাবে। তারপর বলে—রিখি, যা স্বাভাবিক তাই হওয়া উচিত।
স্বাভাবিকটা কী?
বিয়ে।
এই ছোট্ট কথাটায় যেন ঢেউ হয়ে গেল রিখিয়া। লজ্জায়, হাসিতে ভরে গেল তার মুখ।। সামান্য অসংলগ্ন পা ফেলল কয়েকবার। এলো খোঁপা ঠিক করল অকারণে।
রিখিয়া আজ একটুও সাজেনি। সাদামাটা ঘরোয়া পোশাকে বেরিয়ে এসেছে। তবু তার স্বাভাবিক শ্রী থেকে একটা বিকিরণ বেরিয়ে তাকে ঘিরে ধরে।
কিন্তু আমি তো কিছু হতে পারিনি রিখি। আমাকে…
রিখিয়া পাশমুখে তাকিয়ে বলল—হতে বারণ করেছে কে?
কী চাও বলো তো! কেমন চাও আমাকে?
যেমন আছো।
ঠিক?
ঠিক।
—যদি সারাজীবন আর সুন্দরবনের মাস্টারি ছেড়ে আসতে না পারি?
রিখিয়ার এখনও হিসেবি বুদ্ধি হয়নি। অকপটে বলল—আমাকে অত ভয় দেখিয়ো না। তুমি পুরুষমানুষ, ভাবনা-টাবনা তোমার। আমি নিশ্চিন্ত।
সোমেন দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে—কবে এত পাকলে বলো তো রিখি! এই সেদিনও খুকিটি ছিলে।
এখন আর নেই কিন্তু।
॥ আটাত্তর ॥
ভরদুপুরে ননীবালা কাঁচা আম কেটে রোদে শুকোতে দিয়েছেন। আমশির ডাল ব্রজগোপাল বড় ভাল খান। কিছু কলকাতাতেও পাঠানো যাবে।
ব্রজগোপাল দুদিন হল যাজনে বেরিয়েছেন। আজ কালই ফেরার কথা। ননীবালার একটু একা- ফাঁকা লাগে ঠিকই, কিন্তু এখানে জনের অভাব টের পান না। বহেরুর ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি অনবরত আসছে যাচ্ছে। যজমানদেরও আনাগোনা কম কী! তা ছাড়া কামলা, মুনিশ, চাষাভূষোরা অনবরত কাজটাজ করছে। একা লাগে না। পাখি-পক্ষী, কুকুর-বেড়াল, গাছপালা, মাটি-আকাশ নিয়ে বড় প্রাণবন্ত জগৎ। সবাই যেন সঙ্গে থাকে। সঙ্গী হয়।
আমের টুকরো রোদে দিয়ে উঠে আসছেন, উঠোনে একটা লম্বাপানা ফরসা দাড়িঅলা ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে ঢুকেই ডাক দিল—মা!
হাসবেন কি কাঁদবেন তা ভেবে পান না ননীবালা।
ওরে, আয় আয়। বলে নিজে গিয়েই সাপটে ধরেন ছেলেকে। যেন কতকাল দেখেন না।
হাঁকডাক শুনে লোকজন এসে পড়ল। ননীবালা কোকাকে ডেকে বললেন—একটা মাছ। পুকুর থেকে ধরে আন তো।
বলে সোমেনের দিকে চেয়ে বলেন—তোর বাবা কিন্তু মাছ ঢুকতে দেয় না বাড়িতে।
সঙ্গে সঙ্গে সোমেন গম্ভীর হয়ে বলল—তা হলে কেন মাছ রাঁধবে মা? বেঁধো না।
বলে কোকাকে ডেকে নিজেই বারণ করে দিল সোমেন।
ননীবালা বলেন—তা হলে কী দিয়ে দুটো ভাত খাবি? ঘি তো খুব ভালবাসিস, গরম ভাতে এক খাবলা তাই দিয়ে খা তো আগে, তারপর দুটো ডাল ডালনা দিয়ে খাস। দুধ আছে।
সোমেন কৃত্রিম রাগ করে বলে—ভাল করে বাসায় পা না দিতেই খা-খা করতে লাগলে!
খাওয়া নিয়েই তো তোর যত পিটির পিটির। কোথায় যেন মাস্টারি পেয়েছিস, সে কি অনেক দূর?
না, কাছেই।
চিঠি লিখতে তোদের যে কি আলিস্যি। হাকুচ কালো হয়ে গেলি কী করে? অমন টকটকে রং একদম জ্বলে গেছে। নিজের ছেলেটা বলে চিনতে কষ্ট হয়। জামাটা খোেল তো দে। হাড়পাঁজরা কেমন বের হয়েছে।
বোকো না মা। তিন কেজি ওয়েট বেড়েছে।
—উরে বাবা, তাই নাকি? হ্যাঁ। কনুইয়ের তিনকোনা হাড় বেরিয়ে আছে। ওয়েস্ট বেড়েছে কি না সে আমি জানি। এখন এখানে ক’দিন থাকবি। ইচ্ছেমতো খেয়েদেয়ে ঘরে। শরীর সারিয়ে তবে মনে করলে যাবি। বুঝেছিস?
সোমেন কেবল হাসে।
ননীবালা বলেন—হাসলে হবে না বাবা। চিরদিন হাসি দিয়ে আমাকে ভোলাও। কদিন। আমি এখন কাছে কাছে রাখবই। ওই দাড়ি গোঁফ রেখে সন্নিসী হলে চলবে না। কি, ভেবেছিস কি তুই?
চিরকালই যত গোপন কথা মার কাছে বলে সোমেন। আজ দুপুরে মায়ের কাছ ঘেঁষে ছোট্ট শিশুর মতো শুয়েছিল। তখন একটি দুটি প্রশ্নের উত্তরে মা কেমন করে সব কথা বের করে নিল। অবশ্য বলার আগ্রহ সোমেনেরই ছিল আগে থেকে।
শুনে ননীবালা উঠে বসে বললেন—শৈলীর মেয়ের কথা তত তোকে কত জিজ্ঞেস করেছি। তখন গা করতিস না।
এখন কী করব মা?
কী আবার করবি! বিয়ে করবি। আমি আজই শৈলীকে চিঠি লিখব।
দূর। ওসব করো না। ওরা ভীষণ বড়লোক। যদি রিফিউজ করে তো অপমানের একশেষ।
দূর বোকা! ছেলের কোনও কাজে মায়ের আবার মান-সম্মান কী? আমি ওর মেয়েকে ভিক্ষে চাইব।
না মা। অপমান তোমার একার নয়, আমারও। তা ছাড়া, বাবার পরামর্শ আগে নিয়ে। নাও।
এর মধ্যে আবার ওঁকে টানিস কেন? উনি সেকেলে লোক। ভাবের বিয়ে শুনলে খুশি হওয়ার মানুষ নয়।
সোমেন তবু মাথা নেড়ে বলল—শোনো মা, আমার বুদ্ধি স্থির নেই, তুমিও দুনিয়ার কিছু জানো না। এসব ব্যাপারে স্থিরবুদ্ধির লোক চাই। বাবার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।
বিস্মিত ননীবালা ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—ছোটকা, কবে থেকে এত বাপভক্ত হলি বল তো! চিরটাকাল তো মায়ের আঁচলের তলায় বড় হলি, বাপকে চিনলি কবে?
সোমেন পিঠটা মার দিকে ঘুরিয়ে বলে—বাঁ ধারটা চুলকে দাও। জোরে।
ননীবালা একহাতে পিঠ চুলকে দেন, অন্য হাতে পাখার বাতাস করেন। বলেন—সব। শুনে তোর বাবা যদি অমত করে?
এ কথার কোনও উত্তর দেয় না সোমেন। বাবার ডায়েরিতে লেখা একটা বাক্য শুধু মনে পড়ে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।