বেশ দেখতে। শ্যামলার মধ্যে মিষ্টি চেহারা। ভীষণ লাজুক। বিয়ে করো না ওকে সোমেন! করবে? তোমার দাদাকে বলি?
দূর! ওরা আমার সঙ্গে বিয়ে দেবে কেন? আমার কী আছে?
বাজে বোকো না। ভালবেসে বিয়ে করবে, কার কী? দরকার হলে রেজিস্ট্রি করে রাখো, আমি সাক্ষী দেব।
দেবে? বলে হেসে ফেলল সোমেন। বলল—খুব চালাক হয়েছ। শহরে থেকে থেকে অ্যাঁ!
করবে বিয়ে? করো না, লক্ষ্মীটি। দাও তো চিঠিগুলো, দেখি কী লিখেছে।
সোমেন চিঠিগুলো দিয়ে দিল অনায়াসে।
বউদি পড়তে লাগল। পড়ে ভিজে চোখে চেয়ে বলল—আহা রে, কত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালবাসে মেয়েটা। ওকে যদি ফিরিয়ে দাও সোমেন, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনওদিন কথা বলব না।
সোমেন চুপ করে রইল।
সোমেন দাড়ি কামাল না, ফরসা জামাকাপড় পরল না। খুব সাধারণভাবে একদিন চলে গেল রিখিয়াদের বাড়ি। তার শরীর জুড়ে এক তপ্ত জ্বরভাব। সমস্ত স্নায়ুগুলো টনটন করছে এক ক্ষ্যাপাটে আবেগে। যে কোনও সময়ে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে।
রিখিয়া কোখেকে কীভাবে তাকে দেখেছে কে জানে, কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই, নীচের প্রকাণ্ড টবে একটা দেড় মানুষ উঁচু ঘর-সাজানো পামগাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে ভরা চোখে দেখছিল তাকে। তখনও হাঁফাচ্ছে রিখিয়া।
সোমেন তাকে দেখতে পায়নি, স্নায়বিক এক অসহ্য তাড়নায় খুব দ্রুত উঠে গিয়েছিল। মাঝসিড়ি অবধি।
তখন চাপা, জরুরি গলায় রিখিয়া ডাক দিল—শোনো!
ক্ষ্যাপা বাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল সোমেন। পাজামা, পাঞ্জাবি পরা, দাড়িতে চুলে এক জবরজং মূর্তি। খুব চেনা লোকও হট করে চিনতে পারবে না। কিন্তু রিখিয়ার চোখ ভুল করবে কেন! আর, সেই ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে এমন একটা সতেজ সৌন্দর্য ফুটে উঠল সোমেনের যা রিখিয়া কখনও দেখেনি। সোমেনের সৌন্দর্যের মধ্যে এতকাল ছোট্ট একটু অবাক ছিল বুঝি, সে অভাব পূর্ণ হয়ে সোমেন এখন কানায় কানায় সেই পুরুষ, যার সম্পর্কে। রিখিয়ার আর কোনও দ্বিধা নেই।
পামপাতার আড়ালে খুব সাধারণ একটা সাদা খোলের কালোপেড়ে শাড়ি পরে রিখিয়া দাঁড়িয়ে। হাতে পোর মোটা বালা, কানে পলার টব, এলো চুল ঢলের মতো নেমেছে। পিছনে। কচি মুখখানা একটা হাসি কান্নার আলোছায়া ফুটে আছে।
মাঝসিঁড়ি থেকে নিজের লম্বা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে অপ্রতিভ হাসি মুখে সোমেন নেমে এল হলঘরে। বলল—খুব মুডে ছিলাম, তাই তোমাকে দেখতে পাইনি।
রিখিয়া কোখেকে ছুটে এসে এখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখনও হাঁফাচ্ছে অল্প। নাক ফুলে ফুলে উঠছে ঘন শ্বাসে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু হাসল, তারপর দুধারে মাথা নেড়ে বলল—ওপরে যেতে হবে না।
কেন?
পরে যেয়ো। অন্য দিন। তুমি কখনও আমাকে কোথাও নিয়ে যাওনি। আজ নিয়ে যাবে?
শৈলীমাসির সঙ্গে দেখা করব না?
পরে কোরো। আজ আমার অনেক কথা আছে।
কোথায় যাবে?
বাঃ, তার আমি কী জানি? একজন যেখানে নিয়ে যাবে।
তা হলে মাসিকে বলে নাও। পোশাক পালটাবে না?
কিছুই করব না।
সোমেন হেসে ফেলে বললএক—বস্ত্রে চলে যাবে?
রিখিয়ার চোখ ঝিকমিকিয়ে উঠল, বলল—রাজি।
কলকাতার কোথাও বেড়ানোর তেমন জায়গা নেই। লেক-এ গুচ্ছের লোক আর ফিরিওলা, ময়দানে ভিড়, রাস্তাঘাটে অসম্ভব আলো।
অনেক টাকা ট্যাক্সি ভাড়া গুণল সোমেন। কথা তো ভারী!কখনও দুজনে বয়সের হিসেব করে অবাক হয়ে দেখল, সোমেনের চেয়ে রিখিয়া প্রায় বছরের ছোট।
থিয়েটার রোডের একটা দামি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে রিখিয়া হুকুম করল—খাও তো। তোমার খিদে পেয়েছে।
তুমি?
আমি শুধু আইসক্রিম।
এ রকমই সব তুচ্ছ, সামান্য কথাবার্তা। রিখিয়াকে কুড়ি টাকা দিয়ে একটা চামড়ার ব্যাগ কিনে দিল সোমেন। ফিরিওলা প্রথমে বত্রিশ টাকা দাম চেয়েছিল। রিখিয়া তাতেই বাজি। সোমেন তাকে ঠেকিয়ে দরাদরি করে কিনল।
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল—ইস, রোজ আমি তা হলে কত ঠকি!
ভীষণ। আরও ঠকবে তুমি।
কেন ঠকব?
আমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছ বলে।
নতুন কেনা ব্যাগটা ঠাস করে তার পিঠে মারল রিখিয়া। বলল—সেটাই একমাত্র জিৎ। বাবাঃ, যা অহংকারী! পাত্তাই দিতে চায় না।
ঘুরেটুরে একটুও ক্লান্ত হল না দুজনে। কিন্তু রাত সাড়ে আটটায় সাদার্ন অ্যাভেনিউ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে সোমেন বলল—রিখি, এবার বাড়ি যাও, সবাই ভাববে।।
রিখিয়া মুখখানা পাশে ঘুরিয়ে তাকাল। মৃদু একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল—আগে। বলো, আমাদের কী হবে!
বড় জটিল প্রশ্ন। বড় জরুরি প্রশ্ন।
সোমেন তাকায় রিখিয়ার দিকে। কচি বয়সের ভালবাসা আর মায়া মেশানো মুখ। আর। একটু বয়স হলে ও যখন হিসেবি হবে তখন ঠিক এরকম বলতে সাহস পাবে না হয়তো। তখন অনেক সুখ দুঃখের ভবিষ্যৎ-চিন্তা এসে ভর করবে মনে।
সোমেন তার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল—রিখি, তুমি আমার দাড়ি সম্বন্ধে আজ একটাও কথা বলেনি।
রিখিয়া হেসে বলল—তাতে কী হবে? আমার ভাল না লাগলে যেদিন কেটে ফেলতে বলব সেদিনই তো তুমি ঠিক কেটে ফেলবে।
তাই বুঝি?
তা নয় বুঝি?
সোমেন একটা ত্রাস ফেলে বলে—হ্যাঁ, তাই।
তবে মশাই? শোনে, কখনও আমার অবাধ্য হবে না।
না হলাম।
সোমেন একটা ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করে। পারে না। সব ট্যাক্সি অন্য লোক নিয়ে চলে যাচ্ছে।
রিখিয়া নিরুদ্বেগে হাঁটে। এক-একবার হেসে বলে—আমার চেয়ে ওঁর ভয়টা বেশি হল বুঝি?