রিখিয়া জিভ কেটে বলে—ওমা, কখন বললাম! যাঃ। ওটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
সেদিন চলে আসবার আগে রিখিয়া পরদার কাছে কেমন একভাবে দাঁড়িয়েছিল। অকপট চোখে নির্লজ্জের মতো দেখছিল সোমেনকে। দুটি বড় বড় চোখ ভরে নিথর মুগ্ধতা। নিচু স্বরে বলল—শোনেনা, বিদেশে যেয়ো না।
—যাচ্ছি না।
আমার মন ভীষণ খারাপ। তুমি কেন আসো না?
সোমেন বলল—লজ্জা করে। ভীষণ।
একদিন তোমাদের বাসায় নিয়েও গেলে না বেড়াতে। বেশ!
সোমেন একটা গভীর শ্বাস চেপে রেখে বলল—নিয়ে যাব একদিন।
দেখব কেমন নিয়ে যাও!
নিশুত রাতে আদিনাথের বাইরের ঘরে একা বিছানায় উঠে বসল সোমেন। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
প্রবল মনের জোরে নিজেকে ঠেকাল সোমেন, যেমন স্রোতের উজানে নৌকাকে কষ্টে। নিয়ে যেতে হয় তেমনি এক অসম্ভব কষ্টে উজিয়ে আনল নিজের মনকে। তবু স্রোত টানে।। অন্ধের মতো টানে।
॥ সাতাত্তর ॥
স্কুল খুলতে আর মোটে দশ দিন বাকি। বাসন্তী থেকে লঞ্চ-এ ফিরতে একটা লোকের বগলে খবরের কাগজ দেখে চেয়ে নিয়েছিল সোমেন। রবিবারের বড় কাগজ দেখতে দেখতে দুইয়ের পাতায় ‘নিরুদ্দিষ্টের প্রতি কলমে চোখ আটকে গেল। এ কলমে অনেক মজার বিজ্ঞাপন বেরোয় বলে সোমেন নিয়মিত পড়ে। আজ দেখল, প্রথম বিজ্ঞাপনেই তার একটা অস্পষ্ট ছবি, নীচে লেখা—সোমেন, কোথায় আছ ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দাও। সবাই আমরা চিন্তিত। মা বাবা শয্যাশায়ী। দাদা রণেন।।
বিজ্ঞাপন দেখে হঠাৎ হেসে ফেলে সোমেন।
তারপর গম্ভীর মুখে দাড়িতে হাত বোলায়। খবর না দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
কলেজ-ঘাটে লঞ্চ লাগতেই নেমে পড়ল সোমেন। সেখান থেকেই ক্যানিংয়ের ফিরতি লঞ্চ ধরল দুপুরে।
সন্ধেবেলা যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ঢুকছে তখন তার পরনে সাধারণ পাজামা আর পাঞ্জাবি, গালে দাড়ি, কাঁধে ঝোলা, মুখে একটু অপরাধী হাসি।
দাদা বউদি প্রথমে চিনতেই পারেনি কয়েক সেকেন্ড, তারপর হইচই বেধে গেল। রণেন। রেগে গিয়ে চেঁচাতে থাকে—এ তুই কী হয়েছিস! আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড়। প্রত্যেক দিন শীলা আর ইলা খবর নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে কান্নাকাটি। তোর বউদির অবস্থা নিজের চোখে দ্যাখ, কী রকম শুকিয়ে যাচ্ছে সব। |
কথাটা মিথ্যে নয়। বউদি কেঁদেও ফেলল কথা বলতে গিয়ে। বলল—তোমাকে যেতে। তো আমিই বলেছিলাম সোমেন। সেই অপরাধে দিনে দশবার মাথা খুঁড়ছি।
—মা বাবা শয্যাশায়ী বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছ। সত্যি নাকি?
ন। খবর দিলে দুজনেরই স্ট্রোক হয়ে যেত। প্রতি সপ্তাহেই চিঠিতে তোমার কথা লেখেন দুজনে। তোমার চাকরির খবর দিয়েছি নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা জানাইনি।
সোমেন ফের আড্ডা দিতে বেরল। কলকাতাকে অনেক ঘিঞ্জি, ময়লা আর দূষিত বলে মনে হয়। জীবাণুর মতো মানুষ। এ কয় মাসে তো আর কলকাতা পালটায়নি। সোমেনের মন আর.চোখই গেছে পালটে।
পরদিন সকালে বউদি সেফটি রেজার, জল আর আয়না সাজিয়ে দিয়ে বলল—জঙ্গল। সাফ করো তো বাপু, সুন্দর মুখখানা একটু দেখি। নইলে বুঝতে পারছি না, আমার দেওরটাই এল না অন্য লোেক দেওর সেজে এসেছে। কী কালো হয়ে গেছ সোমেন! |
রোগা হইনি তো বউদি?
ন।, একই রকম।
সোমেন হাসল। বলল—তার মানে, একটু গত্তি লেগেছে গাছে কি বলল? তোমরা তো নজর লাগার ভয়ে কাউকে মোটা হয়েছ’ বলতে পারো না।
থুঃ থুঃ। বলে বউদি গায়ে থু থু ছিটোনোর ভাব করে বলল —রং-টা একদম জ্বলে গেছে। অমন রং কি আর ফিরে আসবে?
নোনা জল-হাওয়ায় ওরকম হয়। রং দিয়ে হবেই বা কি বলো! কেউ তো পছন্দ করল ন।।
তাই বুঝি! বলে বউদি ঘরে গিয়ে তক্ষুনি দুটো নীল মুখবন্ধ খাম নিয়ে ফিরে এসে। বলল—মনে ছিল না, কতদিন হল এসে পড়ে আছে। ঠিকানার লেখা দেখে তো মনে হয় পছন্দের লোকই লিখেছে।।
সোমেন খাম দুটো নিয়ে সস্নেহে বীণার দিকে চেয়ে বলে—খুলে পড়োনি তো!
তেমন ভাব নাকি? আচ্ছা যা হোক। পড়লে পড়েছি। ঠিকানা দেবে না, নিরুদ্দেশ হয়ে থাকবে, তো আমরা করব কী? ঠিকানা জানা থাকলে কবে রি-ডাইরেক্ট করে দিতাম।
রিখিয়ার হাতের লেখা সসামেন চেনে। ঝরঝরে। পরিষ্কার, গোটা গোটা অক্ষর। প্রথম। চিঠিটা এসেছিল দুমাস আগে। ছোট্ট চিঠিতে লেখা—কতদিন দেখা নেই। ভয় হচ্ছে বিদেশে চলে যাননি তো? যাবেন না প্লিজ, তা হলে আমার কেউ থাকবে না।…
দ্বিতীয় চিঠিটা বড়। মাত্র সাত আটদিন আগে এসেছে। রিখিয়া লিখেছে..যদি কখনও। এমন ঘটে যে, আপনার সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক রইল না। আমার কথা আপনার মনেও। পড়বে না, জানি। আমার খুব মনে হবে। একদিন অনেক খুঁজে খুঁজে গিয়েছিলাম আপনাদের বাসায়। শুনলাম, মাস্টারি নিয়ে সুন্দরবনে গেছেন। কী ভীষণ কান্না পেয়েছিল শুনে। ঠিকানাটা পর্যন্ত জানাননি। কত ভয় হয় জানেন না তো! আপনি এরকম কেন? যদি চিঠি পান, তবে? তবে কী করবেন? বলে দিতে হবে? নাকি নিজের বুদ্ধিমতো কাজ করবেন? আমি বড় একা। কেন বোঝেন না?…
সোমেন মুখ তুলে বীণাতে বলল—রিখিয়া এসেছিল নাকি বউদি?
বীণা ভ্রু কুঁচকে বলল—রিখিয়া মানে? মায়ের সেই সইয়ের মেয়ে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মস্ত গাড়ি করে একদিন তোমার খোঁজে এসে হাজির। বাচ্চাদের জন্য এত মিষ্টি আর খেলনা এনেছিল। ও কি তারই চিঠি?
হুঁ। সোমেন আস্তে বলে।