তবে কি তার ভবিষ্যৎ বাঁধা আছে নাটকের সঙ্গে?
ঠিক বুঝতে পারে না।
গ্রীষ্মের ছুটি পড়তেই দুরন্ত গরমের মধ্যে সে একবার বেরোল পদযাত্রায়। গাঁয়ে গায়ে। অনেক চেনা হয়ে গেছে। কোথাও তেমন অসুবিধে হয় না। রাস্তাঘাট নেই, যানবাহন নেই, মাঠ ময়দান পেরিয়ে তবু চলে যেতে আজকালতার অসুবিধে হয় না। বর্ষার কাদা অনায়াসে। ভাঙে। চার মাসে সে এক জীবনের অভ্যাস অর্জন করছে।
একদিন গোসাবার নদীর ধারে জ্যোৎস্নারাত্রে বসেছিল আদিনাথ নামে আর একজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। গত দুদিন সে আদিনাথের বাড়িতে আছে। খুব খাতিরযত্ন করে আদিনাথ, কিন্তু তার সঙ্গে সোমেনের মনের পার্থক্য অনেক। সোমেন যেমন গভীরভাবে ভাবতে পারে, অনুভব করতে পারে, আদিনাথ তা পারে না। রাত বারোটার বিপুল জ্যোৎস্নার রহস্যানুভূতি সোমেন যেমন টের পায়, আদিনাথ পায় না। বার বার সে একটা নৌকো চুরির গল্প বলার চেষ্টা করে অবশেষে কাত হয়ে শুয়ে ঘাসে ঘুমোতে লাগল। একা বসে জেগে থাকে সোমেন। পৃথিবীতে এখন সে সম্পূর্ণ একা। যেখানে সে বসে আছে তার বিস হাত পিছনে আদিনাথের ঘুমন্ত বাড়ি। কেউ কোথাও জেগে নেই। বসে থেকে সোমেন জলে জ্যোৎস্না দেখে। কোনও মানে হয় না এই জেগে বসে থাকার, তবু থাকে। একটা আচ্ছন্ন মাতলা ভাব। ভিতরে এক অবিরল অস্থিরতা। কেবলই মনে হয়, কী নেই! কী একটা। নেই যেন!
সে কি মেয়েমানুষ সোমেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে সে। নিজেই ভেবেচিন্তে বলে, হবেও বা। মেয়েমানুয বউ হয়ে এসে জীবনের অনেকখানি একাকীত্ব কেড়ে নেয় বটে, কিন্তু সবটুকু কি পারে নিয়ে নিতে? পারবে কি কিশোরী রিখিয়া?
রিখিয়ার কথা কেন যে ভাবে সোমেন! ভাবার কোনও মানেই হয় না। সে তো এক পেঁয়ো ইস্কুলমাস্টার হয়ে গেল ক্রমে। রিখিয়াদের বাড়ির মাপ মতো পাত্র তো সে নয়। তবে ভেবে কি হবে। তার ভাগ্য তাকে সফলতা দেয়নি, কিছুই হতে দেয়নি জীবনে। তবে কেন এই চাঁদের দিকে দুহাত বাড়ানো ভিখিরির মততা? দেশে তার মতো কত লক্ষ লক্ষ ছেলে তারই মতো অসফল জীবনযাপন করছে। সে তবু যা হোক একটা কাজ পেয়েছে, কত ছেলে তাও পায়নি। গণেশবাবুর দলের সঙ্গে সেক্রেটারির গণ্ডগোল ছিল বলেই সেক্রেটারি তাড়াহুড়ো করে বাইরের ছেলে সোমেনকে চাকরি দিয়েছিল। নইলে এই সামান্য মাস্টারিটুকুর জন্যও উমেদার কম ছিল না, এখানে এসেই সে খবর পেয়েছে। এ কি তার সৌভাগ্য নয়?
সোমেন নিজেকে বলে, এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার ছিল না তোমার।
গাব্বকে এখন কে পড়াচ্ছে। অণিমা কি ফিরল শ্বশুরবাড়ি থেকে? ওর বাচ্চাটাচ্চা হবে কি? অপালা কি মিহির বোসকে এখনও খেলাচ্ছে? পূর্বার বুঝি এখনও কোনও প্রেম হল না, বিয়ে হবে কি? অনেকদিন হেমন্তকে দেখে না সোমেন, গেস্ট কিন ছেড়ে মুম্বই যাবে বলেছিল, চলে গেছে নাকি! একে একে বুবাই টুবাই বেলকুঁড়ি, ননীচোর, বড়দির বাচ্চাটা সকলের কথা মনে পড়ে।
বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলের খাঁজে একটা জোঁক লেগেছে। প্রথম প্রথম এ অঞ্চলে এসে গায়ে জোঁক লাগলে টের পেত না সে, আজকাল পায়। জোঁকটা আঙুলে টিপে ধরে ছাড়িয়ে আনল সে। ছুঁড়ে জলে ফেলে দিল। তারপর আদিনাথের ডেকে বলল—চলো, শুয়ি পড়ি ঘরে।
হাই তুলে আদিনাথ উঠে বসে বলল—জ্যোৎস্নার আর হাওয়ায় ঘুমটা এত জমে!
ঘুমের সঙ্গে জ্যোৎস্নার কী সম্পর্ক তা না ভেবেই সোমেন অন্যমনস্কভাবে হু’ দিয়ে হাঁটতে থাকে। তখন টের পায়, বুকে এখনও একখানা আস্ত পাথরের মতো অভিমান জমে আছে। সকলের ওপর, গোটা পৃথিবীর ওপর তার রাগ।
রিখিয়ার ওপরও। কিন্তু রিখিয়া তো কোনও দোষ করেনি। সোমেনের তবু অভিযোগ, কেন রিখিয়া অত বড়লোকের ঘরে জন্মাল? যদি আমাদের মতো ঘরে জন্ম নিতে তুমি রিখিয়া, তবে কবে তোমাকে বউ করে নিয়ে আসতাম এই সুন্দরবনের গাঁয়ে। কুঁড়েঘরে ডেরা বাঁধতাম।।
মাস ছয়েক আগে এক শীতের বিকেলে রিখিয়াদের বাড়ি গিয়েছিল সোমেন। সেই শেষবার। তারপর আর যাওয়া হয়নি।
রিখিয়া বসেছিল দোতলার বারান্দায়, রেলিঙে হাত, হাতের ওপর থুতনি। একটু কৃশ হয়েছে, একটু গম্ভীরও। তাকে ফটক দিয়ে ঢুকতে দেখেই উঠে ঘরে চলে গেল। হাসল না। পর্যন্ত। রাগ হয়েছিল সোমেনের।
স্বভাবসংকোচের সঙ্গে সিড়ি বেয়ে যেমনি দোতলায় পা দিয়েছে সোমেন, অমনি এক কপাটের আড়াল থেকে আধখানা বেরিয়ে এসে থমথমে মুখে রিখিয়া বলল—খুব, না?
কী খুব?
এমনিতেই আমাদের মন ভাল নেই, তার ওপর আবার একজনের এমন অহংকার হয়েছে। আজকাল।
সসামেন একটু লাল হয়ে বলে—মন ভাল নেই কেন?
বাবা লন্ডন থেকে ঘুরে এল। দাদা ওখানে বিয়ে করেছে।
ওঃ। সোমেন খুব অবাক হয় না। বলে—আমার অহংকার কীসে দেখলে? বরং আমি। লজ্জায় আসতে পারি না।
তুমি ভীষণ অহংকারী।।
‘তুমি’ শুনে কেঁপে গেল সোমেন। কথা এল না মুখে।
রিখিয়া তক্ষুনি ভুল সংশোধন করে বলল—মা পথ চেয়ে থাকে, রোজ জিজ্ঞেস করে—ওরে, সোমেন আসে না? মার ধারণা, আমি একজনের সঙ্গে ঝগড়া করেছি, তাই একজন। আসছে না।
সেই ‘একজন’ যে সে নিজেই তা ভেবে এই এতদিন পরেও গা শিউরে ওঠে। মন আনচান করে সোমেনের।
সসামেন রিখিয়ার দিকে চেয়ে বলল—আবার আপনি-আজ্ঞে হচ্ছে কেন? দিব্বি তো। তুমি করে বলে ফেলেছ। ওটাই চলুক।