গেল না সোমেন। সে কাউকে চিঠি দেয়নি, ঠিকানা জানায়নি। সম্পূর্ণ নিরুদ্দেশ হয়ে। আছে। এ অবস্থাটা আরও কিছুদিন চলুক। চারদিকে তার খোঁজ হোক। তারপর দেখা যাবো।
একদিন ছুটির দুপুরে শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সোমেন। ব্রাহ্মণভোজনের একটা নিমন্ত্রণ ছিল এক বাড়িতে। খুব খাওয়া হয়েছে। এক টাকা দক্ষিণাও পেয়েছে। একজন বুড়ো। লোক নেমতন্ন বাড়িতে তাকে ডেকে বলল—আমার বাবার বাৎসরিকে মন্ত্রটা সামনের। রোববার একটু পড়িয়ে দেবেন মাস্টারমশাই।
সোমেন বলে—মন্ত্র তো জানি না।
লোকটা বিশ্বাস করে না, কেবল বলে—ও আর জানাজানি কী! বিপ্রের ছেলে। আপনারা অং বং যা বলবেন তাই মন্ত্র। রক্তটা তো গায়ে আছে।
সোমেন সেই কথা ভেবে আপনমনে হাসে। ক্ষতি কি? একখানা পুরোহিত দর্পণ জোগাড় করে অবসর সময়ে বসে শিখে নেবে। তার বাবা ব্রজগোপাল এরকম কত করেছেন।
ভেবেই হঠাৎ থমকে গেল সোমেন। মনটা পাশ ফিরল। বাবা! আরে, সোমেনও যে ঠিক তার বাবার মতোই হয়ে যাচ্ছে। এই রকমই এক অভিমানে তার বাবাও গিয়েছিলেন। স্বেচ্ছানির্বাসনে। দূরে বসে একটা জীবন সকলের মঙ্গল চেয়েছেন। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
সোমেন ঠ্যাং নাচানো বন্ধ করে উঠে বসল। বুকে একটা চাপা বেদনার দম আটকানো ব্যথা। সবাইকে ছেড়ে সে চলে এসেছে কত দূরে। এই নিঝুম দুপুরে বসে সে হঠাৎ বুঝতে পারে আজ, কারও ওপর রাগ করে থাকার, অভিমান করে থাকার কোনও মানেই হয় না। সেটা ভীষণ বোকামি হবে।
একটা বাঁধানো খাতায় কয়েকটা কবিতা লিখেছিল সে। সেই খাতাখানার মাঝখানে একটা সাদা পাতা বের করে সে গভীর মনোযোগে সুন্দর হাতের লেখায় লিখল—ভগবান, উহারা। যেন সুখে থাকে।
লিখে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল লেখাটার দিকে। একসময়ে চোখের জলে দৃষ্টি ছেয়ে গেল। ঝাপসা হয়ে আসে বাক্যটি। সোমেন উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে একটু কাঁদে।
তিন মাস পেরিয়ে চার মাসে পড়ল সোমেনের চাকরি। এবার গ্রীষ্মের ছুটি হবে। বড় অসহায় লাগে সোমেনের। দুঃসহ এই ছুটি কি করে কাটাকে সে।
এর মধ্যে সে অনেকবার গোসাবায় গেছে। সুন্দরবনে ঘুরে বেড়িয়েছে, পক্ষী-আবাস দেখতে গেছে। এ অঞ্চলটা ক্রমশ তার অভিজ্ঞতায় চলে আসছে। স্কুলের সবাই তাকে পছন্দ করছে আজকাল। তার সুন্দর চেহারাটি, তার নম্র কথাবার্তা, এ সবই তার বরাবরের মূলধন ছিল। কদাচিৎ কেউ তার শত্রু হয়েছে। সোমেন জানে, মানুষকে ভোলাবার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে তার। কয়েকটা মেয়ের বাপ বড় জ্বালাতন করে আজকাল, তার বাবার ঠিকানা চায়। এ ছাড়া এ অঞ্চলে তার আর কোনও ঝামেলা নেই। কিন্তু এই ছুটি কাটানো বড় মুশকিল হবে।
কলকাতায় যাবে? না, সেটা ঠিক হবে না। সোমেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
মে মাসের গোড়ায় কলকাতার নামজাদা এক সাপ্তাহিকে তার একটা কবিতা বেরল। ক্যানিংয়ে লোক গেলে সে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকা আনিয়ে নেয়। একদিন এরকমই। আনানো কাগজে নিজের কবিতা দেখে বড় অবাক হয়ে গেল সে। অনেক জায়গায় পাঠিয়েছিল কবিতা, এই প্রথম ছাপা হল বড় কাগজে।
খুব কি আনন্দ হল সোমেনের?
না। কারণ, এখানে তার আনন্দে আনন্দ করার কোনও ভাগীদার নেই। আনন্দ তো একার জন্য নয়।
নিজেকেই সে প্রশ্ন করল—জীবনের সব ক্ষেত্রেই কি কথাটা সত্যি নয় সোমেন? জীবনে একা-একা কোনও উপভোগ হয় না। জীবনে যত রকমের আনন্দ আছে তার সবই ভাগ করে নিতে হয়।
মাঝখানে দাড়ি কেটে ফেলেছিল সোমেন। এখন আবার রাখছে। তার দাড়ির রং অল্প লালচে আর নরম। গালে হাত বোলালে রেশমের স্পর্শ পাওয়া যায়। চুলও ছাঁটে না। অনেকদিন। অল্প ঢেউ-খেলানো চুল প্রায় কাঁধে নেমে এল। তার কাছে আয়না নেই। চিরুনিরও ব্যবহার খুব কম। চেহারাটা কেমন দেখতে হয়েছে আজকাল তা তার জানা হয় না। চেহারা নিয়ে কোনও ভাবনাও নেই তার। তাকে সুন্দর দেখলে খুশি হয় এমন মানুষজন। থেকে সে বহুদূরে রয়েছে। এখন তার কেমন একটা আপনভোলা অবস্থা।
সে আজকাল মাছের জাল ফেলতে শিখেছে, নৌকো বাইতে পারে, অল্পস্বল্প চাষবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে। আগে গাছপালা চিনত না, অড়হর গাছকে ভাঙ গাছ বলে ভুল করত। এখন সে সব ভুল বড় একটা হয় না। ইস্কুলের জমি কুপিয়ে চমৎকার বাগান বানিয়ে ফেলেছে। এইভাবে সে এখানকার আবহাওয়ায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে প্রাণপণে।। মাঝে মাঝে ভাবে—এখানেই একটা যে কোনও মেয়েকে বিয়ে করে ফেলি না কেন? হয়ে যাই এখানকার স্থায়ী লোক?
যেই ভাবে অমনি অলক্ষ্যে মেঘগর্জনের মতো ডেকে ওঠে এক অন্ধ ও সতর্ক কুকুর। চোখে ঝলসে যায় একটা ক্যামেরার লেনস। এ তার একটা মনোরোগ। কেন যে বার বার সেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে, আর সেই ক্যামেরার মস্ত একচক্ষু গভীর কাচ!
সে কি খুব বিখ্যাত কবি হবে একদিন? কিছু একটা হবে? মানুষের মতো মানুষ কোনও? নাকি, হয়ে থাকবে এক অসফল ও অভিমানী মানুষ? কিংবা এক ব্যর্থ প্রেমিক? আস্তে আস্তে সে কি হয়ে যাবে একদিন গেঁয়ো কবিয়াল।
বেশ সোরগোল তুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী করাল সে ছেলেদের দিয়ে। গ্রীষ্মের ছুটির দিন। নিজের লেখা একটা নাটক অভিনয় করাল। লোক ভেঙে এল দেখতে। সারাক্ষণ দেখলেও সবাই চোখ কান মন দিয়ে। খুব একটা আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেল সে। নাটকের পর অনেকে এসে পিঠ চাপড়াল।