গোসাবা ছেড়ে পড়বেলায় ছোট নদী বেয়ে নৌকো তাকে নিয়ে চলল কোন অজানা। রাজ্যের মধ্যে। দুধারে হেতালের বন, গোমমা গাছের সারি, শুকনো পাতা ঝরছে। নিচ্ছিদ্র নীরবতা। ঘনিয়ে আসছে মৃত্যুর মতো হিম শীত।।
কলকাতায় এখন আর তত শীত নেই। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ চলছে। কিন্তু এখানে শীতের কামড় বসে আছে। নদীর ওপরে একটি ভাসা বাতাস। ঘোলাটে কুয়াশা। লালচে রোদ গাছগাছালির দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে।
লম্বা লোকটা ওই স্কুলের সেক্রেটারি। বলল—এখন কোনও ভয়টয় নেই। সাপখোপ এ সময়ে থাকে না।
—বাঘ?
লোকটা হেসে বলে—বাঘ কোথায়? সে অনেক দূর সেই রিজার্ভ ফরেস্টে। দুই আড়াই মাইল হবে।
বাঘের কথা অবশ্য মোটেই চিন্তা করছিল না সোমেন; এমনিই মনে পড়ল বলে বলল। সে ঝুকে নদীর ঠান্ডা চলন্ত জলে হাত দিয়ে এককোষ জল তুলে ছিটিয়ে দিল। দুলে দুলে নৌকো যাচ্ছে।
সেক্রেটারির চিঠিতে গোটা তিনেক ভুল ইংরেজি ছিল, মনে পড়ল। সোমেনের একটু হাসি পেল। কিন্তু লোকটা এমনিতে বেশ আলাপী। ভাল লোক, না মন্দ লোক তা বুঝতে কিছু সময় লাগবে সোমেনের।
লোকটা ইস্কুলের এক গণেশবাবুর নিন্দে করছিল খুব। বার বার বলল—ওদের গ্রুপের সঙ্গে একদম মিশবেন না কিন্তু। ইস্কুলটার ওরাই সর্বনাশ করছে।
এসব কথা সোমেনের গভীরে পৌঁছোয় না। সে শুধু ভাবে, এখানকার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, গভীর নিস্তব্ধতা, আর নিঃসঙ্গ সময় তার কেমন লাগবে?
মাইলের পর মাইল কোনও গ্রামের চিহ্ন প্রায় নেই। এক-আধটা ছোট গাঁ-ঘর দেখা যায় বটে, তারপর অনেকটা ফাঁকা। নদীর ধারে কোনও মানুষ, কুকুর, বেড়াল কিছু চোখে পড়ে না।
নৌকো ভিড়ল এক আঘাটায়। ভাটির টানে জল সরে গিয়ে গোড়ালি-ডুব কাদা বেরিয়ে পড়েছে। টকটকে লাল রঙের হাজার হাজার কাঁকড়া হালকা পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কাদার ওপর। মানুষের সাড়া পেয়ে মাটিতে সেঁধিয়ে গেল।
কাদায় পা দিতে হল না সোমেনকে। মাঝি দুজন তাকে কাঁধে বয়ে পিছল খাড়া পাড় বেয়ে বাঁধে দাঁড় করিয়ে দিল। মালপত্র তুলে নৌকোটা টেনে হড় হড় করে কাদায় এনে ফেলল। তারপর রওনা দিল সবাই। আদিগন্ত মাঠ ভেঙে পথ আর ফুরোয় না। টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। গভীর ছায়া ঘনিয়ে আসছে মাঠে। দূরে এক সবুজাভ গভীর বনের রেখা দেখা যায়। সেক্রেটারি দেখিয়ে বলল—ওই ওখানে বড় নদীর ধারে রিজার্ভ ফরেস্ট।
সোমেন বৈরাগ্যভরে দেখল। এদিকে রাস্তাঘাট নেই। যানবাহন চলে না। বহেরুর গ্রাম এর তুলনায় অনেক আধুনিক।
সেক্রেটারি বলল—ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। এখনও তেমন কিছু হয়নি।
কলকাতা থেকে কত দূরে যে এসে পড়ল সোমেন! শীতের সন্ধ্যার মতোই ভার আর বিষন্ন হয়ে গেল মনটা। বড় অনাত্মীয় এই গ্রাম। বড় অচেনা। মনটা খারাপ হতেই ফের ম্যাক্স-এর মুখ মনে পড়ে গেল। রোগা, তীব্র কৌতূহলে ভরা একখানা মুখ। পোড়-খাওয়া। রোদে জলে ঘাতসহ একটা চেহারা। পৃথিবীর মানুষ।
ইস্কুলের সায়েন্সরুমের এক পাশে চৌকি পাতা। হারিকেন জ্বলছে।
—এইখানে থাকবেন। ইস্কুলের বেয়ারাও থাকে, রান্নাবান্নাও সেই করে দেবেখন।
সন্ধেবেলা কয়েকজন দেখা করতে এল। অন্যরকম মানুষ সব। কেউ বেশি চালাক-চালাক। কথা বলে। কেউ একটু ঠেশ দিয়ে দু-চারটে বাকা বলে। দু-একজন বেশ গম্ভীর। সে এসেছে। বলে কেউ কি খুশি হয়েছে? কিংবা দুঃখিত? বুঝল না সোমেন। হারিকেনের আলোয় সে তো ভাল দেখতে পায় না। অভ্যাস নেই।
দিন যায়। রাত যায়। ক্যালেন্ডার দেখে না সোমেন। ইস্কুলের সময়ে মাঠ-ঘাট পেরিয়ে বহুদূর থেকে ছেলেদের আসতে দেখে। যেন ওরা মাটির ভিতর থেকে উদ্ভিদের মতো জন্ম নিয়ে চলে আসছে, আবার ছুটি হলে ফিরে যাবে মাটির তলায়। রাত হলে সারা ইস্কুলবাড়িটায় ফাঁকা নির্জনতায় হাওয়া বয়ে আসে অদূর সমুদ্র থেকে। কত দেশ দেশান্তরের কথা বলে।
কয়েকবারই পৌঁছে সংবাদ দেবে বলে পোস্টকার্ডে ঠিকানা লিখে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত কাউকেই চিঠি দিল না। বুকজোড়া কেন যে এই অভিমান! মনে হয়, তাকে কেউ বুঝল না, চিনল না, কেউ ভালবাসল না। তার জন্য কে ভাবছে বুকভরা দুঃখ নিয়ে? কেউ না।।
সারাটা দিন প্রায়ই কাজ থাকে না। চার-পাঁচটা ক্লাস করে সোমেন। তারপরই কর্মহীনতা। দু-চারজন তাস খেলতে নিয়ে গেছে কয়েকবার। এক রাতে যাত্রা দেখল দুটো বিয়ের প্রস্তাব এসে গেল এর মধ্যেই। ছাত্রদের বাড়ি থেকে প্রায় সময়েই নানারকম ফল, সবজি বা মাছও আসে। মাসখানেকের মধ্যে দু-চারজন ছেলে লণ্ঠন ঝুলিয়ে চলে এল প্রাইভেট পড়তে, সন্ধেবেলাটায় কাজ পেয়ে বেঁচে গেল সোমেন। মাথাপিছু কুড়ি টাকা মাসে, তাতে প্রায় আশি। টাকা বাড়তি রোজগার।
প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই একদিন ঠিক করল, কলকাতা যাবে। ভেবে শনিবার টিফিনে ছুটি করে নিয়ে সাজগোজও করে ফেলল সে। ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি। হঠাৎ বেরোবার মুখে। হার্ট অ্যাটাকের মতো একটা অভিমানের যন্ত্রণা দেখা দিল বুকে। কেন যাব? কার কাছে যাব? আমার তো কেউ নেই!
সাজ খুলে না ফেলেই অনেকক্ষণ বসে রইল সোমেন। জানলা দিয়ে পুকুরঘাটে গাছের ছায়ায় চেয়ে রইল। একটা গরিব মেয়ে কচুর শাক তুলছে। অনেকক্ষণ চেয়ে রইল সোদকে। ভাবল, এ জায়গায় যতদিন মন না বসছে ততদিন কলকাতায় না যাওয়াই ভাল। তা হলে আর ফিরতে ইচ্ছে করবে না।