বাড়িটা আজকাল খাঁ-খাঁ লাগে। যতদিন যায় তত মায়ের কথা মনে পড়ে। আর শুধুই মা নয়, আরও একটা কী যেন অভাবের হাহাকার বুকের মধ্যে কুয়ো খোঁড়ে দিনরাত। সেটা যে কী তা বোঝা যায় না, ভাষা দিয়ে কিছুতেই তার চেহারা ফোটে না। মনে হয়, কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল। যখন অপালা, পূর্বা, শ্যামদের সঙ্গে রইরই আড্ডা হয়, সিনেমায় যায়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরে, ফুটবল মাঠে গিয়ে চেঁচায়, টেস্ট ক্রেকেট দেখতে ভোর রাতে গিয়ে রঞ্জি স্টেডিয়ামে লাইন দেয়, তখনও হঠাৎ হঠাৎ ওই এক ভূতুড়ে কী-নেই কী-নেই ব্যাকুলতায় বুকটা খালি খালি লাগে।
সোমেন সবচেয়ে কম যায় রিখিয়াদের বাড়িতে। বরাবরই সে স্বভাবে লাজুক। আজকাল সে অমোঘভাবে বুঝে গেছে, রিখিয়ার মতো কেউ তাকে এত চুম্বকের মতো টানে না। সমস্ত কাজকর্ম, অন্যমনস্কতার ভিতরেও অলক্ষিতে তার ভিতরে একটা কাঁটা থর থর করে কেঁপে কেঁপে একটা দিক নির্দেশ করে। যে ঘরে কাঁটাটা গিয়ে কাঁপে সেই হচ্ছে রিখিয়ার ঘর। যখনই এটা টের পেল সোমেন তখনই হাতে-পায়ে লজ্জার ভার এসে চেপে ধরল। আজকাল সে কেবলই ভাবে—ছিঃ, বেশি গেলে ও আমাকে হ্যাংলা ভাববে।
কলকাতায় থেকে আর লাভও নেই সোমেনের। পত্রিকা দেখে মফঃস্বলের স্কুলে কয়েকটা দরখাস্ত পাঠিয়েছিল। কয়েকটা স্কুল থেকে ইন্টারভিউ এল। শুধু বিজয়নগর স্কুলই সরাসরি নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছে। চিঠিটা পেয়ে অনেক ভেবেছে সোমেন। বউদি আর দাদাও শুনেছে।
রাত্রে দাদা খেতে বসে বলল—সুন্দরবন! সেখানে তো খুব বাঘের উপদ্রব হয়েছে শুনি।
বউদি প্রতিবাদ করে বলল—আহা, মানুষ বুঝি তা বলে আর সেখানে নেই!
দাদা মাথা নেড়ে বলে—থাকগে। সোমেনকে যেতে হবে না অত দূরে। মা চলে গেল, বাবা চলে গেল, এখন সসামেন গেলে বাড়িতে টেকা যাবে না। তুই যাবি না সোমেন।
বউদি অবশ্য চুপ করে রইল। কিন্তু সসামেন জানে, বউদির এ ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। সূক্ষ্ম এক ধরনের অনাদর যেন সে আজকাল টের পায়।।
রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত প্রায় সিগারেট খেতে খেতে ভেবেছে। যাবে কি যাবে না! এতদিনকার কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতে বড় কষ্ট হয়। আবার ভাবে, থেকেই বা হবে কী!
খুব ভোরবেলার দিকে হঠাৎ খুব শান্তভাবে সে সিন্ধান্ত নিল। যাবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে ম্যাক্স-এর একটা সুদূর প্রভাব কাজ করেছিল তার মনে। সে ম্যাক্সকে দেখেছে। পড়াশুনো ফেলে রেখে যখন-তখন বেরিয়ে পড়ত গ্রামে গঞ্জে, সুদূর দুর্গম অঞ্চলে। পয়সাকড়ির চিন্তাও করত না। কখনও গাড়িতে, কখনও পায়ে হেঁটে, যেমন-তেমন করে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে দেখে গেছে ম্যাক্স। শরীরে কোনও আলস্য ছিল না রোগা সাহেবটার। মনে ছিল না কোনও জড়তা বা বন্ধন। সে যেন এই বিশাল দুনিয়ায় এক সদানন্দ মুক্ত পুরুষ, কোথাও নোঙর বাঁধেনি। অনেক চোখে দেখা, উপলব্ধি করা জ্ঞান ঝুলি ভরে নিয়ে গেছে। ম্যাক্স। সোমেনকে সে প্রায়ই বলত—তোমরা কি করে বসে বসে অলস সময় কাটাও? তোমার দেশের লোকের অনেক কাজ পড়ে আছে। শ্রীকৃষ্ণ তোমাদের কর্মের কথা। বলেননি? আর কিছু না পারো, বেরিয়ে পড়ো দেশ দেখতে। তোমার দেশটা কেমন তাও তুমি জানো না সোমেন। শুধু কলকাতা নিয়ে পড়ে আছে।
ম্যাক্স-এর সেসব কথা বড্ড মনে পড়ে সোমেনের। সত্যিই তো, দেশটার কিছু অন্তত তার দেখা দরকার। তা ছাড়া, ইদানীং সংসারের ওপর তার একটা অবুঝ অভিমান জন্ম নিয়েছে। কেবলই তার মনে হয়, কেউ তাকে বোঝে না, ভালবাসে না, আপন বলে ভাবে না। তার নিজের মানুষ কেউই বুঝি নেই।
বিজয়নগর যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে সে ভোরে উঠে স্যুটকেস গুছিয়েছে নিজেই। বিছানা বেঁধেছে।
ঘুম থেকে উঠে বউদি বলল—ও মা! এ কি! যাচ্ছো না কি?
—যাই বউদি। কিছু একটা করা দরকার।
—আমি তো তাই বলি। কিন্তু তোমার দাদাকে বুঝিয়ে বলে যাও, নইলে আবার অস্থির হবেন।
রণেন উঠে সব শুনেটুনে কেমন উদাস হয়ে যায়। বলে—চলে যাচ্ছিস? তোকে এখনও আমি খাইয়ে পরিয়ে রাখতে পারি।
—সে তো রেখেছই। তবু একটু ছেড়ে দাও এবার। ভাল না লাগলে চলে আসব।
রণেন কি ভেবে অনেকক্ষণ বাদে বলল—যা।
ক্যানিং-এর গাড়ি পৌনে সাতটায়। স্টেশনে এসেই রিখিয়ার বাড়িতে ফোন করবে বলে। ডাক্তারখানায় গেল। দোকানটা খোলেনি তখনও। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বিপিন কম্পাউন্ডারকে। তুলে নিল টেলিফোন করে সোমেন ফিরে আসে স্টেশনে। গলায় একটা কান্নার দলা ঠেলা মারছে। চলে যাচ্ছে রিখিয়া।।
গাড়ি আসে।
স্বপ্নের ভিতর দিয়ে সোমেন যেতে থাকে। ভাবনার ঘোরের আচ্ছন্নতার ভিতর দিয়ে গেল। ক্যানিং-এর দীর্ঘ বাঁধের রাস্তা পার হয়। পুরনো আমলের লঞ্চ, জোয়ার ঠেলে ঘাটে ঘাটে ঠেকে আস্তে ধীরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে কলকাতা থেকে দূরে। দেশের গভর বুকের মধ্যে।
গোসাবার ঘাটে নৌকো ছিল। একজন কালো, লম্বামতো সরল লোক, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, দুজন মাঝি সমেত অপেক্ষায় ছিল। পরিচয় দেওয়ার আগেই তারা কী করে যেন চিনে। ফেলল সোমেনকে। লম্বা লোকটা বলল—যেতে তো দেরি হয়ে যাবে। এখনই বেলা একটা। প্রায়। এখানেই এক বাড়িতে আপনার জন্য রান্না করা আছে।
এ জায়গাতে একসময়ে লন্ডন অফ দি ইস্ট বলা হত। হ্যামিলটন সাহেবের কুঠিবাড়ি আছে এখানে। কিন্তু এ গঞ্জে একটুও ভাল রাস্তাঘাট নেই, মোটরগাড়ি বা রিকশা নেই। এক আদিম পৃথিবীর দৱজা খুলে গঞ্জটা বসে আছে। যে বাড়িতে খেলো সোমেন তা গেরস্তবাড়ি।। খুব যত্ন করল।