—না, তোমাদের সবসময়েই রোগ দেখা।
—হ্যাঁ রে, একা লাগে না ঘরটার মধ্যে ওখানে, অ্যাঁ? মায়ের কথা মনেও পড়ে না বুঝি?
সোমেন হেসে লজ্জার ভাব করে বলে—পড়বে না কেন?
—খুব সিগারেট খাস, না? ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। চোখ বসা কেন? রাগবাগ করিস না তো বউদির সঙ্গে?
—না না। তুমি যে কি ভাবো!
ননীবালা কাঙালের মতো বলেন—এখন তো তোর হাতে কোনও কাজ নেই, থাকবি এখানে কদিন?
—এখানে?
—তবে কোথায় বলছি! থেকে যা, একটু শরীরটা সারিয়ে দেবখন। আমাদের দু-দুটো গোরু রোজ পনেরো ষোললা সের দুধ দিচ্ছে। কত তরিতরকারি, মাছ, ফল খায় কে! এত। ঘি আর ক্ষীর করে রেখেছি। আজ সবাইকে দিয়ে দিচ্ছি কলকাতার জন্য। তুই কদিন থেকে যা।।
সোমেন উদাস গলায় বলে—পাগল হয়েছ! কলকাতায় কত কাজ!
—আহা! কী কাজ তা তো জানি! একশো টাকার একটা টিউশানি।
সোমেন মৃদু হেসে বলে—না মা, তুমি খোঁজ রাখো না। সেই টিউশানি আছে বটে, আবার এক বন্ধুর সঙ্গে ঠিকাদারির কাজে নেমেছি।
—তাই নাকি?
অবশ্য আমার তো টাকা নেই, তাই খুব কিছু হয় না। টাকা থাকলে হত।
—তোর বাবার কাছ থেকে নিস।
—বাবা! সোমেন অবাক হয়ে বলে—বাবা কোখেকে দেবেন?
জবাব দিতে গিয়ে ননীবালার গলাটা অহংকারি হয়ে যায়, তবু আস্তে করে বলে—তাঁকে ভিখিরি ভাবিস না। আমার এখানে লক্ষ্মীর বাস। চেয়ে দেখিস, দেবেন।
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—এখন থাক। পরে দরকার মতো দেখা যাবে।
খাওয়া-দাওয়া সারতেই শীতের বেলা ফুরিয়ে গেল। দূর মাঠপ্রান্তরে সন্ধ্যার ঘনায়মান। আবছায়া। পাখি উড়ে যাচ্ছে বাসার দিকে। দিনশেষ। সারাদিন লোকজন ছিল, তারা সব। বিদায় নিয়েছে। কুকুরেরা এখনও ঝগড়া করছে এঁটো পাতা নিয়ে, কাক ওড়াউড়ি করছে। হু-হু করে শীতের বাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
মেয়েরা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। সাজও শেষ। ছেলেরা জামাইরা পোশাক। পরে বসে আছে নতুন বাড়ির বারান্দায়। ননীবালা কাঁদছেন শীলার ছেলেকে বুকে চেপে, অন্য হাতে ধরা আছে টুবাই। আঁচল ধরে টান দিচ্ছে ননীচোর। সারাদিনে তার দিদিমার মত খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। বেলকুঁড়ি আর বুবাই কাঁদছে, রণেন ভ্যাবলার মতো বাপের পাশে বসে আছে বারান্দায়। দুই জামাই নিচু স্বরে কথা বলছে পরস্পর। সোমেন বাড়ির বাগানে। কুয়োর ধারে আড়ালে সিগারেট খায়।
কে যেন রাস্তায় হাঁক পাড়ছে—কলকাতার লোকেরা ফিরবে, চারটে রিকশা নিয়ে আয় গগাবিন্দপুর থেকে। ছটার গাড়ি ধরবে সব।।
সোমেন ঘড়ি দেখে বিরক্ত হয়। খুব বেশি সময় নেই। মেয়েছেলে যেখানে, সেখানেই। দেরি।
রিকশা এসে গেল। হর্ন মারছে। ছেলেরা এগিয়ে গেল। মেয়েরা ননীবালাকে ঘিরে কাঁদছে এখনও।।
—আবার কবে আসবি সব? ননীবালা জিজ্ঞেস করেন।
—আসব মা, এখন তো আমাদেরই বাড়ি এটা।
—ওসব মুখের কথা। ননীবালা বলেন—শোন, তোদের বাড়ির সব উৎসব অনুষ্ঠান যখন করবি, তখন এ বাড়িতে এসে করিস। আমি খরচা দেব। কলকাতার মানুষদের না হয় পার্টি। দিবি।
এ সবই স্তোক। জানেন ননীবালা, ওরকম হয় না। হবে না। চোখের জলের ভিতর দিয়ে ভাঙাচোরা দেখায় চারধার। সেই অস্পষ্ট দৃষ্টির ভিতর দিয়েই ওরা চলে গেল। রিকশা। যোজন-বিস্তৃত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। পৃথিবীটা কী বিশাল!
একা-একা ঘরের দিকে ফিরছিলেন দুজন। ব্রজগোপাল বললেন—আজ আর কোথাও বেরবো না।
ঘরে এসে অন্ধকারেই বসলেন ননীবালা। বুকটা খামচে ধরে আছে চাপা একটা দুঃখ, একটা ব্যথা। একটু বাদেই নয়নতারা এসে লণ্ঠন জ্বালে। বিন্দু এসে ননীবালার চুল আঁচড়ে দিতে থাকে। বহেরু এসে বাইরের ঘরে তক্তপোশের তলায় মেঝেতে ব্রজগোপালের পায়ের কাছে বসে থাকে। তত্ত্বকথা শোনে। ষষ্ঠীচরণ তার বইপত্র নিয়ে এসে গুটি গুটি খোলা। দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে। মতিরাম আনাচ-কানাচ দিয়ে ঘুরঘুর করে আর কুকুর বেড়াল তাড়ায়। দিগম্বর খোল নিয়ে এসে বসে বাইরের ঘরের কোনে। ষষ্ঠীর মা আসে খোঁজ নিতে, বহেরুর বউ আসে। ঘর ভরে যায়। মানুষজন বড় ভালবাসেন ব্রজঠাকুর। মানুষজনও তাই তাঁকে ভালবাসে। ননীবালার খারাপ লাগে না। ওরা এসে চলে গেল বলে যে দুঃখটা ছিল। তা উবে গেল মুহুর্তের মধ্যে। একটু বাদেই তিনি হেসে কথা বলতে থাকেন। এখানে তিনি কত্রী, ব্রজবামুনের বামনি ঠাকরুন, তাঁর দাম অনেক।
॥ ছিয়াত্তর ॥
বিখিয়াদের বাড়ির ফোন অনেকক্ষণ ধরে বাজল। এ-পাশে সোমেন কান পেতে সেই গুড়ুক গুড়ুক তামাক খাওয়ার মতো শব্দ শুনছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কেউ ধরল না। ঘড়ি ধরে প্রায় সাত মিনিট।
কী আর করে সোমেন, হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিল। ওরা হয়তো কেউ বাড়িতে নেই।
রিখিয়ার সঙ্গে একবার মুখোমুখি দেখা হলে বড় ভাল হত। কিন্তু আর তো সময় নেই। কাল বিকেলের ডাকে বিজয়নগর ইস্কুল থেকে একটা চিঠি এসেছে! আজকের তারিখে চাকরিতে যোগ দিতে হবে।
জায়গাটা কত দূরে তা সঠিক জানে না সোমেন। তবে, ইস্কুলের চিঠিতে পথের হদিশ দেওয়া আছে। ট্রেনে ক্যানিং, সেখান থেকে লঞ্চ ধরে গোসাবা। গোসাবার ঘাটে ওরা নৌকো। রাখবে। নৌকোয় আরও ঘণ্টাখানেকের পথ, তারপর খানিকটা হাঁটা। সুন্দরবনের একদম কোলের মধ্যে।
কত কিছু হওয়ার কথা ছিল সোমেনের। হল না। না হল আমেরিকায় যাওয়া, না হল বন্ধুর সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যাবসা। লক্ষ্মণদা গিয়ে কোনও আশা ভরসার চিঠি দিলেন না। সোমেনকে। বোধ হয় ভুলেই গেছেন।