ফেরার পথে সোমেন জিজ্ঞেস করল—বাবা এখানে এসে করে কী?
বহেরু সামনে হাঁটছে। লাঠিয়াল চেহারা। কাঁধে চাদর ফেলা। উত্তরে বাতাস দিচ্ছে টেনে। রোদ ফুঁড়ে বাতাসের কামড় বসে যাচ্ছে শরীরে। বহেরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। লং ক্লথের ফতুয়ার আড়ালে চওড়া কাঁধ। অহংকারী চেহারা। খুলনা জেলার গাঁয়ে সে ছিল কখনও কামলা, কখনও ডাকাত, কখনও দাঙ্গাবাজ, আবার কিছু কিছু ভাগের চাষও করত, শীতের নদীতে মাছ ধরতে যেত, আবার সোমেনদের দেশের বাড়িতে ঘরামি বা মুনিশও খেটে গেছে। দেশ ভাগাভাগির সময়ে সে একটা সুযোগ নেয়। যশোর আর খুলনার রাস্তায় ঘরছাড়া মানুষদের ওপর হামলা করে সে কিছু কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। শোনা যায়, নিজের দলের গোটা চারেক লোককে কেটে সে ভাগীদার কমিয়ে ফেলে। গোবিন্দপুরে এসে এক মুসলমান চাষির সঙ্গে দেশের জমি বদলাবার অছিলায় তাকে উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। তারপর এই উন্নতি। সেই উন্নতিটাই কঠিন এবং সহজ শরীরের অহংকারে ফুটে উঠেছে এখন।
মুখটা না ফিরিয়েই জবাব দিল বহেরু—কী আর করবেন! বুড়ো মানুষ। এমনভাবে ‘বুড়োমানুষ’ কথাটা বলল যেন বা সে নিজে তেমন বুড়োমানুষ নয়। একটু ভেবেচিন্তে সাবধানে বলে—সারাদিন পুঁথুপত্রই নাড়াচাড়া করেন, খুড়োমশাইয়ের কাছে সাঁঝ সকাল খোলের বোল তোলেন, কচি-কাঁচাগুলোকে লেখাপড়াও করান একটু-আধটু, রোগেভোগে ওষুধপত্র দেন। মাঝে মাঝে বাই চাপলে এধার-ওধার চলে যান। যেমন এখন গেছেন।
—কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি?
বহেরু মাথা নাড়ল—কথাবার্তা তো বলেন না বেশি। বলাকওয়ার ধার ধারেন না। আমরা ভাবলাম বুঝি কলকাতাতেই গেলেন, ঠাকরুন আর ছানাপোনাকে দেখা দিয়ে আসবেন। গেছেন তো মোটে চারদিন।
—না বহেরু, একমাস হয় আমরা কোনও খবরবার্তা পাইনি!
বহেরু দুশ্চিন্তাহীন গলায় বলে—আছেন কোথাও। উদাসী মানুষ। যেদিন মন হবে ফিরে আসবেনখন। ভাববেন না।
বহেরুর কথাটায় একটু তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। বাবার প্রতি নয়, তার প্রতি বা তাদের প্রতি। যেন বা বাবা কোথায় আছে তা জেনেও বলার চাড় নেই বহেরুর। বহেরু কি বুঝে গেছে যে বাবার খোঁজে সোমেনদের আর সত্যিই দরকার নেই? খোঁজখবর করাটা বাহুল্য মাত্র?
মাঠটা পার হয়ে এল তারা। বড় রাস্তাটা অন্তত পঁচিশ ত্রিশ বছরের পুরনো, পাথরকুচির রাস্তা। কোনওকালে বোধ হয় মেরামত হয়নি, গোরুর গাড়ির চাকায় আর গত বর্ষার জলে চষা জমির মতো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে, তারই পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে বহেরুর খামারবাড়ি। আশেপাশে আর গাঁ-ঘর নেই। গোবিন্দপুরের বসত আরও কিছু উত্তরে। বহেরুর খামারবাড়িতে আটচালা, চারচালা, দোচালা মিশিয়ে দশ-বারোখানা ঘর। আর আছে গোশালা, ঘানিঘর, ঢেঁকিঘর, কাঠের মাচানের ওপর জাল দেওয়া একটা হাঁস-মুরগির পোলট্রিও। প্রায় স্বয়ম্ভর ব্যবস্থা। জামাকাপড় আর শৌখিন জিনিসপত্র ছাড়া বহেরুদের প্রায় কিছুই কিনতে হয় না।
বাড়ির হাতায় পা দিয়ে বহেরু হাত তুলে উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল—ওই গোবিন্দপুরের লোকগুলো খচ্চর। আমি এখানে নিজের মতো একখানা গাঁ করব। বহেরু গাঁ।
চোখ দুটো আবার রোদে ঝিকলো। ঠাট্টার কথা নয়, বহেরু হয়তো বা পারে। সে ভাগচাষি বা বরগাদার নয়। সে নিজস্ব জোতের মালিক, পয়সায় সোমেনদের কেনাবেচা করার মতো ধনী। তবু যে সে সোমেনদের জমি চষে দেয়, ফসলের দাম দেয়, সে তার দয়া। একসময়ে সে সোমেনদের বাপ-দাদুর নুন খেয়েছে। বাড়ির চাকরবাকরের মতো ছিল। দান উলটে গেছে এখন। সোমেনের বাবা বোধ হয় এখন বহেরুরই একজন কর্মচারী মাত্র, বাচ্চাদের পড়ায়, তার অর্থ প্রাইভেট টিউটর, হিসেবনিকেশও বোধ হয় কিছু করে দেয়। তার মানে, বাবা এখন বহেরুর ম্যানেজার কিংবা নায়েব। এ পর্যন্ত যখন বহেরু পেরেছে, নিজের নামে একখানা গাঁয়ের প্রতিষ্ঠা করতেও পারবে। জ্ঞাতিগুষ্টি মিলিয়ে বহেরুর পরিবারেই প্রায় এক গাঁ লোকজন।
উঠোন থেকে খোলের শব্দ আসছে। কাল সন্ধেবেলাও শুনেছিল খোলের শব্দ, আবার খুব ভোরে। বহেরুর নব্বই বছর বয়সি জ্ঞাতি খুড়ো দিগম্বরের ওই এক শখ। এ বাড়িতে বোধ হয় ওই লোকটিই স্বার্থশূন্য এক বাতিক নিয়ে আছে। ক্ষেতখামার, বিষয়-আশয় বোঝে না। বোঝে কেবল খোলের শব্দ। তাতেই মাতাল হয়ে আছে। ভোররাতে সোমেন ঘুম ভেঙে প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা আটকাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু দূরাগত মেঘের গুরু গুরু ধ্বনির মতো শব্দটা খুব সহজেই তার বুকে ঘা মারতে থাকে। চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে ওই শব্দটা যেন ওই নিস্তব্ধতারই একটা স্পষ্ট রূপ। বাজনার কিছুই জানে না সোমেন। কিন্তু ক্রমে ওই শব্দ তাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সব শব্দের প্রতি বধির করে দিল। না-টানা সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে। সে অনুভব করে তার হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ডুবডাব শব্দ আস্তে আস্তে বদলে যায়। বহেরুর বুড়ো খুড়োর আঙুলের টোকায় টোকায় নাচে তার আনন্দিত হৃৎপিণ্ড।
সকালে উঠেই সে তাই প্রথমে বুড়ো লোকটাকে খুঁজে বের করে।
—বড় ভাল বাজান তো আপনি!
ঘোলাটে ছোট ছোট দুই চোখ, বেঁটেখাটো চেহারা এ বয়সেও মজবুত, আঙুলগুলোর ডগায় কড়া, ঝুপ্পুস এক নোংরা তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে রোদে বসেছিল মহানিম গাছটার তলায়। হাতে কাঁসার গ্লাসে চা। সোমেনের কথা শুনে কেঁপে ওঠে বুড়ো, হাতের চা চলকে যায়। বলে—আমি?