- বইয়ের নামঃ যাও পাখি
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন
যাও পাখি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
TABLE OF CONTENTS[SHOW]
.
“রা-স্বা”
শ্রীতুলসী সেনগুপ্ত
শ্ৰীমতী কৃষ্ণা সেনগুপ্ত
করকমলেষু
.
“রা-স্বা”
গ্রন্থকারের নিবেদন
এই গ্রন্থের প্রথম উদ্ধৃতিটি আমার পরমারাধ্য গুরুদেব পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের। কাহিনীর আখ্যান ও সংলাপ অংশে তাঁর আরও অনেক বাণী ব্যবহৃত হয়েছে।
আমার শ্রদ্ধেয় ইষ্টভ্রাতা পরলোকগত হিরন্ময় মুন্সীর “ইসলাম দীপ্তি” গ্রন্থ থেকে প্রচুর সাহায্য গ্রহণ করেছি।
‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সময়ে বহুল অংশে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে।
.
“তুমি ঠিক ঠিক জেনো যে তুমি
তোমার, তোমার নিজ পরিবারের,
দশের এবং দেশের বর্তমান ও
ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।”
.
॥ এক ॥
সোমেন জানে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন।
ব্যাপারটা সে টের পেল শনিবার সকালে, বৈঁচী স্টেশন থেকে আড়াই মাইল উত্তরে গোবিন্দপুর গাঁয়ে বহেরুর কিচেন গার্ডেনে বসে। কিচেন গার্ডেন বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। বহেরু তার বিশাল পরিবারের সবজিটা এই ক্ষেতে ফলিয়ে নেয়। আড়েদিঘে ক্ষেতটা চার-পাঁচ বিঘে হেসেখেলে হবে। বহেরু আদ্যিকালের চাষা নয়, কেমিক্যাল সার, ইনসেকটিসাইডসের সব বৃত্তান্ত জানে। জানে ব্যাঙ্কের সুদের হার, রাইটার্স বিল্ডিংস বা বি-ডি-ও অফিসে গিয়ে মুখচোরা জোড়হাত চাষার মতো ঈশ্বর ভরসায় বসে থাকে না চোটেপাটে কথা বলে কাজ আদায় করে আসে। বহেরু যে উন্নতি করেছে তা তার এই সবজিক্ষেতের উন্নত সতেজ সবুজ রং সংকেতে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু দূরেই চলছে পাঁচ-ঘোড়ার পাম্পসেট। ডিজেলের গন্ধ আর ফটফট শব্দ। বছরে বার-দুই সে ভাড়া করে ট্যাক্টর। বহেরুর পরিবারের নামে বা বেনামে কত জমি আছে তার হিসেব সোমেন জানে না। আন্দাজ করে দেড় দুশো বিঘে হবে। অনেক আগে যখন এখানে আসত সোমেন তখন অত বাড়বাড়ন্ত দেখেনি। মাঠের ধান উঠে গেছে। পড়ে আছে ন্যাড়া মাথায় সদ্য গজানো চুলের মতো কাঁটা কাঁটা ধানের গোড়া। তবু সেই ক্ষেত সারা সকাল ধরে দেখিয়েছে তাকে বহেরু। দু-চার জায়গায় আগুনের চিহ্ন পড়ে আছে মাটিতে। এ জায়গায় আখের চাষ হয়। বহেরু মোটা সুতির একটা ভাগলপুরী চাদর গায়ে, পরনে ধুতি আর পায়ে বাটা কোম্পানির মজবুত একজোড়া খাকি রঙের হকিবুট পরে ঘুরে ঘুরে তাকে খানিকটা জমিজিরেত দেখাল। একবার দাঁড়িয়ে পড়ে সখেদে একটা ঢেলা বুটের ডগায় উলটে দিয়ে বলল—মাটির কি আর নিজের দুধ আছে।
—কি বল বহেরু? সোমেন জিজ্ঞেস করল।
—মাটির নিজের রস হল মায়ের বুকের দুধের মতো। কেমিক্যাল সার হচ্ছে গুঁড়ো দুধ, সেই নকল দুধ মায়ের বুকে ভরে দেওয়া। ছেলেবেলা যেমন স্বাদ পেতেন সবজিতে, এখন আর পান?
সোমেন মুশকিলে পড়ে যায়। শাকসবজির স্বাদ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না, পাতে দিলে সে মটর শাকের সঙ্গে খেসারির শাকের তফাত বুঝতে পারে না। চুপ করে রইল।
—এ মাটি হচ্ছে এখন ওষুধের জোরে বেঁচে থাকা রুগি। নিজের জোর বল নেই। ওষুধ পড়লে বছর-বিয়োনী বাঁজা বনে যাবে।
খালধার পর্যন্ত যেতে যেতে রোদ চড়ে গেল। বহেরু ভাগলপুরী চাদরখানা খুলে ফেলল গা থেকে। গায়ে একটা ফতুয়া। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস কে বলবে? হাতে বুকে ঢিলে চামড়ার তলা থেকে ডিম-ডিম পেশি পিছলোচ্ছে। গর্দানখানা ভাল খাঁড়া দিয়েও এক কোপে নামানো যাবে না, এত নিরেট। চুলে পাক ধরেছে কিন্তু চোখ দুখানা এখনও রোদে ঝিকোয়। বিশাল লম্বা বহেরু। চাদরখানা খুলে মাটির বাঁধের ওপর যখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল তখনই অস্পষ্টভাবে সোমেন ভিটামিনের কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছিল। ঢালুতে দাঁড়িয়ে সোমেন দেখে বাঁধের ওপরে শীতের ফিরোজা আকাশের গায়ে বিশাল স্তম্ভের মতো উঠে গেছে বহেরুর শরীর। এখানে রোদে বাতাসেও ভিটামিন ভেসে বেড়ায় নাকি? সেই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিনও? কতকাল ধরে বহেরু প্রায় একরকমের আছে। নিমের দাঁতনে মাজা স্টেনলেস স্টিলের মতো শক্ত দাঁত দেখিয়ে হেসে বহেরু হাত তুলে খালধারে একটা অনির্দিষ্ট এলাকা দেখিয়ে বলল—এই হচ্ছে আপনাদের জমি, একলপ্তে পাঁচ বিঘে। পোটাক উজিয়ে গেলে আরও এক বিঘে আছে আপনাদের, সে কিন্তু অনাবাদি, মরা জমি। ঠাকরুনকে বলবেন, সে জমিতে চাষ দিতে এখনও দু-তিন বর্ষা লাগবে।
গতকাল তাড়াতাড়ি কিট ব্যাগ গুছিয়ে দুপুরের বর্ধমান লোকাল ধরেছে সোমেন। তাড়াহুড়োয় ভুলভ্রান্তি হয়। আজ সকালে দেখে টুথব্রাশ আনেনি। বহেরুর ছেলে শক্ত দেখে নিমডাল কেটে দিয়েছিল, সকালে সেটা আধঘণ্টা চিবিয়ে মাড়ি ছড়ে গেছে, মুখে বিদঘুটে স্বাদ। বহেরুর সত্তর বছরের পুরনো আসল দাঁতগুলোর দিকে চেয়ে সোমেন মুগ্ধ হয়ে গেল। ক্লোরোফিলের কাজ।
কাল রাতে তার সম্মানে বহেরু মুরগি মেরেছিল। এরা ব্রাহ্মণের পাতে নিজেদের হাতের রান্না দেয় না। সোমেনকে নিজে বেঁধে নিতে হয়েছে। খুব তেল-ঘি-রসুন-পেঁয়াজ-লংকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তেমন কষায়নি বলে মাংসটা জমেনি তেমন। খিদের মুখে একপেট সেই ঝোলভাত খেয়েছে। এগারো ঘণ্টা পর আজ সকালে সেই মাংসের একটা ঢেকুর উঠল। সোমেন হাতের পাতায় চোখের রোদ আড়াল করে ধু-ধু মাঠ ময়দান দেখে।