ছেলেমেয়ে হয়নি, বাঁজা ময়না এখনও নিঃসঙ্গ পড়ে থাকে ছোট বাড়িটায়। ঘুম থেকে তার এক ভাইঝি আসে, কিছু দিন থেকে যায়। হরেন বোস রিটায়ার করে বাড়ি করেছিলেন দার্জিলিঙে। কিছু দিন আগে মারা গেছেন। তার বউ বা ছেলেপুলেরাও আসে মাঝে মাঝে, ময়নাও যায়। কিন্তু ময়না একা। বড় একা।
২. পুন্নিকে দেখতে এলেন
পুন্নিকে দেখতে এলেন একজন। রিকশা থেকে বুড়ো মানুষটি যখন নামছিলেন তখনই তার ফরসা টুকটুকে নাদুসনুদুস চেহারাটা দেখে সকলের ভাল লেগে গেল। পুন্নির বাপ আবেগে দিগিনকে বলে ফেললেন, দেখেন, যেন ঠিক পাকনা শসা।
তা পাকা শসার মতোই চেহারা বটে। মুখে অবশ্য হাসি নেই। গম্ভীর হয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ এসে বসলেন। চারধারে একটু চেয়ে দেখলেন। কথা কম হলেও বেরসিক নন। জলখাবারের প্লেটটা আসতে দেখে বললেন, সেই লৌকিকতা।
না না, কিছু নয়। বলে পুন্নির বাপ, একটু মিষ্টিমুখ আর কী।
রক্তে চিনি একশো কুড়ি। আপনার মেয়ের মুখশ্রী যদি মিষ্টি হয় তা হলেই হবে, আলাদা মিষ্টির দরকার নেই।
ভারী ম্লান হয়ে গেলে পুন্নির বাপা পুন্নির মুখশ্রী তেমন মিষ্টি নয়, সবাই জানে। তবুপুন্নিকে আনা হল। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ অবশ্য পুন্নির দিকে এক পলকের বেশি চেয়ে দেখলেন না। চিনি ছাড়া চা তৈরি করে দিতে হয়েছিল নতুন করে, সেইটে চুমুক দিতে দিতে বললেন, যেতে পারো মা। তোমার গার্জিয়ানদের সঙ্গে কথা বলি বরং।
পুন্নি চলে যেতেই দিগিনের উকিল দাদা জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখলেন? চলবে?
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, রং তো কালোই, মুখশ্রী ওই চলনসই।
পুন্নির বাবা বলতে গেল, কিন্তু কাজকর্ম—
ভদ্রলোক হাত তুলে বললেন, ও তো সবাই জানে। ঘরের কাজকর্ম তো আর জজিয়তি ব্যারিস্টারি নয়।
দিগিনের দিকে চাইলেন ভদ্রলোক। বললেন, কী দেবেন আপনারা?
যা চান।–দিগিন গম্ভীর হয়ে গেলেন।
চাওয়ার কী? আপনাদের বাজেটটা না জেনে বলি কী করে?
যা সবাই দেয়। আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ফার্নিচার, খাট, গয়না, ছেলের আংটি, ঘড়ি।
হুঁ।-বলে গম্ভীরভাবে আবার চা খেলেন। বললেন, আলমারি তো গোদরেজের?
তা-ই হবে।
গয়না?
চোদ্দো-পনেরো ভরি।
ঘড়িটা?
রোলেক্স।
ভদ্রলোক শ্বাস ফেললেন। তারপর বলেন, আমি কী পাব?
মানে?
ছেলে আর ছেলের বউ তো এ সব পাবে। আমার পাওনা কী?
কী চান?
নগদ।
বলুন কত?
আমি বলব না। শুনব।
তখন সবাই পীড়াপীড়ি করতে থাকে ভদ্রলোককে কিছু একটা বলার জন্য। ভদ্রলোক কেবলই হাতজোড় কবে বলেন, আমি কিছু বলব না, আরও চার জায়গায় মেয়ে দেখেছি। সকলেরই টাকার অঙ্ক পেয়েছি। সব লিখে জামশেদপুরে জানাব আমার স্ত্রীকে। তিনি সব বিচার করে যেখানে মত দেন সেখানেই হবে। আমি দূত মাত্র, আপনারা সবাই বরং পাশের ঘর থেকে টাকার ব্যাপার পরামর্শ করে ঠিক করে আসুন।
বোঝা গেল, লোকটা স্বাভাবিকভাবেই একজন ডিকটেটার। সব জায়গায় কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে। দিগিনের দাদারা আর দুই ভগ্নিপতি পাশের ঘরে চলে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বড়দা ডেকে গেলেন, দিগিন। দিগিন গেলেন না। মাদ্রাজি চুরুট ধরিয়ে ঠায় বসে রইলেন লোকটার দিকে চেয়ে।
একটু পরে ওঁরা ফিরে এলে বড়দা বললেন, আমরা দুই হাজার নগদ দেব।
দুই!–ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করেন।
দিগিন লোকটার দিকে চেয়ে রইলেন মাদ্রাজি চুরুটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে। তারপর হঠাৎ বললেন, দশ।
অ্যাঁ।–ভদ্রলোক তাকালেন।
দশ হাজার দেব। নগদ।
ভদ্রলোক হাঁ করে চেয়ে থাকেন। বাক্যহারা দুই দাদা আর দুই ভগ্নিপতি সন্দেহের চোখে দেখেন। কিছু বুঝতে পারেন না।
ভদ্রলোক একটা শ্বাস ফেলে বলেন, আচ্ছা।
আচ্ছা নয়, দশ হাজার দেব। বিয়ের পাকা কথা দয়া করে আজই বলে যান। নইলে আমরা অন্য পাত্র দেখি।
ভদ্রলোক ইতস্তত করতে থাকেন। দিগিন গিনিপিগ দেখার মতো করে কৌতূহলী চোখে ভদ্রলোককে দেখেন। মানুষ-গিনিপিগের মধ্যে কোন কথায় বা কোন অবস্থায় কী রকম প্রতিক্রিয়া হয় সেটা লক্ষ করা দিগিনের এক প্রিয় অভ্যাস।
ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত ভাবটা ঝরে যায়। ফরসা মুখখানায় একটু লাল আভা ফুটে ওঠে।
দিগিন মৃদুস্বরে বলে, আমার বড় আদরের ভাগনি। মনে মনে বহুদিনের ইচ্ছে ওর একটা ভাল বিয়ে দিই। কাজেই পুন্নির জন্য আমি আলাদা খরচ করব। আপনি চিন্তা করবেন না।
কিন্তু আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু পরামর্শ
কথাটা শেষ করতে পারেন না ভদ্রলোক।
দিগিন বলেন, সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমরা দেরি করতে পারব না। আমার দাদাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চাকরির ছেলে পছন্দ নইলে একটি ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আমার হাতেই ছিল। আপনি যদি আজ স্পষ্ট মতামত না দেন তা হলে আমরা তো দেরি করতে পারি না।
ভদ্রলোকের কঠিন ব্যক্তিত্বের এবং কর্তৃত্বের ভাবটা খসে গেছে। লাল মুখখানা রুমালে ঘষে আর-একটু লাল করে তুললেন। আধ-খাওয়া জলের গ্লাসটায় এক বার চুমুক দিলেন।
তারপর বললেন, আলমারিটা গোদরেজের তো?
নিশ্চয়ই।
সোনা যদি আর একটু বাড়াতেন।
দিগিন চুরুট মুখে নিয়ে বলেন, পনেরো ভরি তো দেওয়াই হচ্ছে আমাদের ফ্যামিলি থেকে। আমি নিজে একটা পাঁচ ভরির নেকলেস দেব। আর প্রত্যেকটি এক ভরি ওজনের ছ-গাছা চুড়ি।
আমার ছেলে কী পাবে? এ তো মেয়ের কথা হল, ভালই
একটা স্কুটার দেব, একটা ফ্রিজ।