দিগিন বুঝতে পারেন, ছেলেটাকে ভয় দেখিয়ে বা পুন্নিকে চোখ রাঙিয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু অত সহজে তিনি বাড়ির লোকের মতে মত দিতে পারলেন না। ছেলেটার দুঃসাহস এবং দুষ্টুবুদ্ধি তার ভিতরটাকে শক্ত করে তুলল। কিন্তু মুখে তিনি কিছু বললেন না, মতামত দিলেন না। শুধু একদিন অমলকে ডেকে গোপনে বললেন, আমার ভাগনির সঙ্গে তোমার ভাব শুনছি, ঠিক নাকি?
ছেলেটা মাথা নিচু করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ।
বিয়ে তো করবে, কিন্তু কাজ-টাজ কিছু করছ?
চেষ্টা করছি।
চেষ্টায় কী হবে? ধরা করার কেউ আছে?
না।
ঠিক আছে, সে ভার আমি নিচ্ছি। তবে একটা কথা, চাকরি পাকা হওয়ার আগে বিয়ে-টিয়ে হবে না কিন্তু।
ছেলেটা চাকরির কথায় যথেষ্ট শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠেছিল দিগিনের প্রতি। বলল, আজ্ঞে না। এম-ই-এস-এর প্রায় সব হর্তাকর্তাকেই চেনেন দিগিন। তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। ক্লাস ফোর স্টাফ হিসেবে তার চাকরি হয় এবং চাকরি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আসামের নেফায় তাকে বদলি করা হয়। সমস্ত ব্যাপারটাই দিগিন খুব নিপুণভাবে করেছিলেন। কেউ কিছু টের পায়নি। সবাই জেনেছিল হবু জামাইকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই দিগিনের এই চেষ্টা। পুন্নিও বোধহয় খুশি হযেছিল। অমল নেফায় যাওয়ার আগেই একদিন পুন্নিকে ডেকে দিগিন বললেন, ওর কাছ থেকে তোর চিঠিগুলি চেয়ে নিবি।
কেন ছোটমামা?
মিলিটারির সঙ্গে থাকবে, আজ এ জায়গায়, কাল সে জায়গায়, ওগুলো হারিয়ে যদি ফেলে, আর অন্য কারও হাতে যদি পড়ে লজ্জার ব্যাপার।
পুনি লজ্জা পেয়ে বলে, আচ্ছা।
সব ক’টা চেয়ে নিবি, নইলে কিন্তু ছাড়বি না।
যদি দিতে না চায়?
দেবে, বলিস না-দিলে ছোটমামা রাগ করবে। চিঠিপত্র ছছাটমামা পছন্দ করে না। কে কোথায় দেখে ফেলবে।
চিঠি ফেরত দিয়েছিল অমল। নেফা থেকে কয়েকখানা চিঠি লিখে থাকবে। বছরে এক-আধবার আসে, দেখাসাক্ষাৎও বোধহয় করে পুন্নির সঙ্গে। কিন্তু পুন্নির প্রেমের দুধ কেটে ছানা হয়ে গেছে, এ সত্য পুন্নির মুখ দেখলেই আজকাল বোঝা যায়। সঙ্গ বন্ধ করে দিলে যে কত ফলস প্রেম নাকচ হয়ে যায়।
অমল ক’দিন আগেই এসে ঘুরে গেছে। শিগগির আর আসবে না। এই ফাঁকে পুন্নিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে পাচার করতে পারলে ভয়ের কিছু থাকবে না। প্রেমের তেজটাও কমজোরি হয়ে এসেছে। বাড়ির লোকও ব্যাপারটা ভুলে গেছে। কেবল দিগিন ভোলেননি। দুটো গিনিপিগের ওপর তার প্রেম-বিষয়ক পরীক্ষাটা তিনি চালিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তার ফলাফলটা দেখবেন বলেই ভোলেননি।
কয়েক দিন পরে এসে পাটিপত্র করে যাবেন বলে কথা দিয়ে ভদ্রলোক উঠলেন।
এর আগে পুন্নির দুটো সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছিল উড়োচিঠির জন্য। কে বা কারা উড়ো চিঠি দিয়েছিল কে জানে।
তবে দিগিনের পরিবারের শত্রু কেউ কেউ থাকাই সম্ভব। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেও কি নেই। মাৎসর্যে আক্রান্ত লোক। এবার নিশ্চিতভাবে পাত্রটিকে কিনে নিলেন দিগিন, উড়োচিঠিতে বোধ হয় আর কাজ হবে না।
ভদ্রলোক চলে যেতে দিগিন নিজের টংগি ঘরখানায় এসে বসেন। মনটা ভাল নেই। উত্তরে মেঘপুঞ্জ জমে উঠেছে। বেলা পড়ে এল। একটু শীত বাতাস বয় আজকাল, দিগিন ইজিচেয়ারে বসে টুলের উপর পা তুলে দেন। পুন্নির বিয়ে হয়ে গেলে তার একটু একা লাগবে। পুন্নিটা খুব সেবা করত।
পুন্নির কথা ভাবতে ভাবতেই পুন্নি উঠে এল নীচে থেকে।
ছোটমামা।
হু।
তুমি কী কাণ্ডটা করলে শুনি।
কী?
অত টাকা খরচ করে বিয়ে দেবে?
না হয় দিলাম।
ছি ছি, লোকে কী বলবে?
কী বলবে?
ভাল বলবে না। আমারও বিশ্রী লাগবে। বড়মামা, মেজোমামা, মেসোমশাই কেউ খুশি হয়নি।
কেন, কেউ কিছু বলেছে নাকি?
বলেছে।
কী?
কী আবার। পাত্র আন্দাজে দেওয়া-থোওয়া বড্ড বেশি হয়ে গেছে।
সে আমি বুঝব। তোর পাকামির দরকার কী? যা চা করে আন।
পুন্নি রাগ করে বলে, আমি এ বিয়ে করব না।
না করিস না করবি। আমি ঠিক দকলীর সঙ্গে সম্বন্ধ করে দেব।
তুমি অত টাকা খরচ করবে কেন? ওতে আমার সম্মান থাকে না।
সে আমি বুঝব। সম্মান নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।
পুন্নি চা করতে যায়।
বড়বউদি এসে ডাকেন, দিগিন ভাই।
হু।
তাজ্জব। পুন্নির কি টাকার সঙ্গে সম্বন্ধ করলে?
করলাম।
এত কিছুতে রাজি হলে কেন? কী এমন পাত্র?
পাত্র খারাপ না।
তা হলেই বা। নগদ দশ হাজার, স্কুটার, ফ্রিজ, সোনা, তুমি কী ভেবেছ বলো দেখি? ওরা তো অত পাওনার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমি আগ বাড়িয়ে বললে কেন?
মুখ বন্ধ করে দিলাম। আর টু শব্দও করতে পারবে না।
কেন? আরও অনেক কমেই তো হত। দশ হাজার নগদ শুনেই তো কাত হয়ে পড়েছিল।
দিগিন হাসেন। তিনি আসলে একটি সুন্দর বৃদ্ধের আকৃতির গিনিপিগকেই লক্ষ করেছিলেন সারাক্ষণ। যখন বুঝলেন ভদ্রলোকের টাকা-কেন্দ্রিক মন, তখন তিনি তাকে লোভানির পর লোভানিতে উসকে তুলেছিলেন। লোকটার নির্বিকার ব্যক্তিত্ব, ঠান্ডা মেজাজ ঝরে গেল, কর্তৃত্বের ভাবটা পড়ল খসে। মানুষ-গিনিপিগের বেশি কিছু নয়।
বউদির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ঠাকরান, আজ ভাল করে শুটকি মাছ রাঁধো তো।
কেন, কেউ খাবে নাকি?
হু।
কে?
ভটচায, আমার ব্যাঙ্কের এজেন্ট।
মাইফেল বসবে, না?
দিগিন হেসে বলেন, ঠাকরোন, তুমি মাইফেলের মানেই জানো না।
বয়স হল, এখন ও সব ছাড়ো না!