অতটা হবে না। কী জানিস, ঝিনুকটা তো আজ পালিয়ে গেল, দুঃখে দুঃখে খানিকটা খেয়ে ফেললাম।
পালিয়ে গেছে আর ইউ শিয়োর?
তা ছাড়া আর কী হবে? সঙ্গে বৈশম্পায়ন। দুইয়ে দুইয়ে চার।
তা হলে দুঃখের কী? সেলিব্রেট কর।
তাই করছি আসলে। দুঃখ প্লাস সেলিব্রেশন। তবে বড় একা লাগছে। চলে আয়। আর কত দেরি করবি?
স্নান করে জামাকাপড় পালটেই আসছি।
.
১৪.
গড়িয়াহাটে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে দু’জনে সূর্যাস্ত দেখল।
আপনার কোনও ডাকনাম নেই?–ঝিনুক আস্তে করে জিজ্ঞেস করে।
বৈশম্পায়ন ফিসফিস করে বলে, আছে। মন্টু।
আমার এক ভাইয়ের নামও মন্টু। ভারী মিষ্টি নাম।
আপনার ভাল লাগলেই ভাল।
কিন্তু আপনি ভারী অদ্ভুত। ওর কোনও বন্ধুই আমাকে আপনি করে বলে না। শুধু আপনি বলেন। কেন বলুন তো!
বৈশম্পায়ন একটু লাল হয়ে বলে, এমনি৷
না। আমার ওসব আপনি-আজ্ঞে ভাল লাগে না। বলুন তুমি! বলুন শিগগির।
তু-তুমি।
শুধু তুমি বললেই হবে না। পুরো একটা বাক্য বলুন।
বলব?
বলতেই তো বলছি।
ঝিনুক! তুমি কী সুন্দর।
বাঃ, বেশ বলেছেন!—ঝিনুক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবেগ ভরা গলায় বলে, কতকাল আমাকে কেউ সুন্দর কথা বলেনি। আমি যে সুন্দর সে কথা মনে করিয়ে দেয়নি।
মাধব? মাধবও নয়।
মাধব। মাধব আমাকে একটুও ভালবাসে না। বউকে ভালবাসলে কেউ মদ খায় বলুন!
যুক্তিটা ঠিক বুঝতে পারে না বৈশম্পায়ন, তবে এ নিয়ে আর কথা বাড়াতেও সে আগ্রহ বোধ করে না। তার মুখ গরম, চোখ জ্বালা করছে, গা ঘামছে। অদ্ভুত এক ভালবাসাই এসব ঘটাচ্ছে। সে ঢোক গিলে বলল, ঝিনুক, আমাদের তো খুব বেশি সময় নেই। একটা কথা বলে নেব?
ঝিনুক খুব অবাক হয়ে ফিরে তাকায় বৈশম্পায়নের দিকে, সময় নেই। কীসের সময় নেই বলুন তো!
আয়ুর সময় যে কেটে যাচ্ছে ঝিনুক। যৌবন যায়, বয়স যায়, লগ্ন যায়।
আপনি যে কী সুন্দর কথা বলেন। আমিও ঠিক এসব কথাই ভাবি। আমরা বোধহয় খুব বেশিদিন বাঁচব না, না? আমার তো এমনিতেই মাঝে মাঝে খুব মরে যেতে ইচ্ছে করে।
কেন ঝিনুক?
কেবল মনে হয়, একদিন খুব বন্যা হয়ে আমরা সবাই ড়ুবে যাব। কিংবা কেউ আকাশ থেকে অ্যাটম বোমা ফেলবে। না হয় তো ওই যে কী একটা রোগ হচ্ছে বাঁকুড়ায়, এনকেফেলাইটিস না কী যেন, সেই রোগটা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়বে আর আমরা সবাই মাথায় রক্ত উঠে মরে যাব। এত ভয় নিয়ে বাঁচা যায়, বলুন তো! তার ওপর গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে যেতে পারে, ভূমিকম্প হতে পারে, গুন্ডা বদমাশ ডাকাত এসে ঘরে ঢুকে খুন করে যেতে পারে, বলুন!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৈশম্পায়ন বলে, তা ঠিক। তবে ওসব কিছু না হলেও এমনিতেই আমরা আস্তে আস্তে বয়স্ক বুড়ো হয়ে যাব ঝিনুক।
আপনার বয়স কত?
বত্রিশ-তেত্রিশ।
যা গম্ভীর হয়ে থাকেন, আপনাকে আরও বেশি দেখায়।
আমি আর মাধব একবয়সি।
জানি জানি। আপনাকে আমি মোটেই বুড়ো বলিনি।
কিন্তু বুড়ো তো একদিন হব ঝিনুক। তুমি হবে, আমি হব, মাধব হবে। সময় বয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছ না?
আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি, বয়স নিয়ে আর ভয় দেখাতে হবে না।
তুমি কি ভয় পাও ঝিনুক!
বুড়ো হতে, মরতে কে না ভয় পায় বলুন। কিন্তু কী একটা কথা বলতে চাইছিলেন যে! হাবিজাবি কথায় সেটা হারিয়ে যাচ্ছে।
কথাটা হারিয়ে গেলেই হয়তো ভাল ছিল ঝিনুক। বলব?
ঝিনুক মৃদু একটু লজ্জার পরাগে মাখা মুখটি মিষ্টি করে নামায়, তারপর মৃদুস্বরে বলে, বলুন না।
কিন্তু বলবে কী করে বৈশম্পায়ন? খুব কাছ ঘেঁষে একটা পায়জামা পরা লোক কখন এসে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে পাছা চুলকোচ্ছে। কিছু লোকের কাণ্ডজ্ঞানের এত অভাব!
বৈশম্পায়ন একটু বিরক্তির গলায় বলে, চলো আর কয়েক পা দুরে গিয়ে দাঁড়াই।
কয়েক পা হেঁটে তারা লোকটার কাছ থেকে নিরাপদ দুরতে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই যে একটা বাধা পড়ল এতেই মুডটা একদম নষ্ট হয়ে গেল বৈশম্পায়নের। সে অনেকক্ষণ রেলিং-এ ভর রেখে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে রইল। অনেকদিন আগে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে শেষবারের মতো দেখা, বলাই সিংহী লেনে লাহাবাড়ির দেয়ালের পটভূমিতে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা সেই মেয়েটিকে তো আর কখনও পৃথিবীতে দেখা যাবে না। কিছুতেই ফিরবে না বয়স। কিছুতেই উজানে যাবে না তো নদী। নদী শুধু বয়ে যেতে জানে একমুখে। তার কলধ্বনিতে শুধু মৃত্যুর গান। তার ফঁকা শুন্য উপত্যকায় সাদা আর নিশ্চল হিম পাথরেরা পড়ে থাকে।
খুব হাওয়া দিচ্ছিল আজ। বজবজের একটা ট্রেন প্রায় নিঃশব্দে পায়ের তলা দিয়ে চলে গেল।
বৈশম্পায়ন বলল, ঝিনুক?
উ!
কী ভাবছ?
কত কী! এইমাত্র ইচ্ছে করছিল ওই ট্রেনটায় উঠে অনেক দূর চলে যাই।
কিন্তু ট্রেনটা তত বেশি দূর যাবে না। মাত্র বজবজ পর্যন্ত।
বজবজ কি সমুদ্রের কাছে?
না। গঙ্গার কাছে।
সমুদ্রের কাছে কোনও ট্রেন যায় না?
যাবে না কেন! অনেক ট্রেন যায়। তুমি কি সমুদ্র দেখোনি?
বহুবার। শুধু পুরীতেই গেছি পাঁচবার; ওয়ালটেয়ার, মাদ্রাজ, বম্বে, ঘরের কাছে দিঘা
তবু যেতে ইচ্ছে করে?
করে। কে যে আমার নাম ঝিনুক রেখেছিল। আমার কেবলই মনে হয় সমুদ্রের কাছে আমার অনেক ঋণ!
তোমাকে ডাকে সমুদ্র, আর আমাকে ডাকে এক নদী।
তাই নাকি?
তবে সে এক মৃত্যুর নদী। এক নির্জন উপত্যকা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সাদা পাথর। আর কী যে করুণ সেই নদীর গান।