বাবলু কথা বাড়াতে সাহস পেল না। নিজের পরিচয় দিয়ে সে ঢুকতে পারে বটে, কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হবে। সে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে এসে মোবাইলে পিউকে ধরল।
পিউদি, প্রবলেম।
কী হল?
রিসেপশন আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
আচ্ছা, তুমি কী বলো তো! নিজের পরিচয় দিয়েই তো গটগট করে ঢুকতে পারো, কে বারণ করবে?
না না, বাবা আমাদের প্রোটোকল মানতে শিখিয়েছেন। ওটা করা ঠিক হবে না। এটা ভিজিটিং আওয়ার্সও নয়।
দাঁড়াও, আমি নীচে আসছি।
আসতে হবে না। রাখীর কণ্ডিশনটা কী?
ডাক্তারি ভাষায় বলব?
বলো।
সেমি কোমাটিক। ব্লাড টেস্টে পয়জন অ্যানালাইজিং এখনও হয়নি। মনে হয় ওভারডোজ অফ অ্যালজোলাম।
রেসপণ্ড করছে?
না। এখনও ক্রিটিক্যাল। কেবিনে যাবে?
কেউ দেখে ফেলবে না তো।
না যাওয়াই ভালো। মৃন্ময়ীদি এখনও বোধহয় রাখীর কেবিনে রয়ে গেছেন। ভিজিটিং আওয়ার্স চল্লিশ মিনিট আগে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জানোই তো, উনি ইনফ্লুয়েনশিয়াল মানুষ, ওকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। আমিও তো ওঁর ছাত্রী।
মৃন্ময়ীদি নাকি বলছেন যে, এটা অ্যাটেম্পট টু মার্ডার?
তাই তো শুনছি।
পুলিশ কী বলছ?
পুলিশ কী কিছু বলে? গোমড়া মুখে আসে যায়। শিবদাস দারোগা হল গোমড়ামুখোদের মধ্যেও যেন আরও গোমড়ামুখো। লোকটাকে কখনো হাসতে দেখিনি।
রাখীর মাথার উণ্ডটা দেখেছে?
হ্যাঁ। ডীপ উণ্ড।
স্ক্যান হয়েছে?
হয়েছে। রিপোর্ট দেয়নি এখনও। অত ভেবো না। পেটে যা টকসিন ছিল তা বের করে দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন গ্লুকোজ চলছে। ইউরিনের সঙ্গে খানিকটা বেরোবে। অ্যান্টিডোট দেওয়া হচ্ছে। বয়স কম, শী উইল কাম অ্যারাউণ্ড। ডায়ালিসিস আরম্ভ হয়েছে।
জানি। কেসটা হয়তো ফ্যাটাল নয়। কিন্তু আমার কেসটা ফ্যাটাল।
তোমার আবার কী কেস?
বুঝতে পারছি না রাখীর এই ঘটনার কারণ আমি হতে পারি কিনা। আমাকে মৃন্ময়ী কোনোদিন পছন্দ করতেন না। ইদানিং রাখী করছে না। ব্যাপারটা কী পিউদি?
ভাবছ কেন? মেয়েটা সেরে উঠুক তারপর কথা বলে দেখো।
আমাকে কালকেই ফিরে যেতে হবে। উপায় নেই।
চলে যাও। টেনশন কোরো না। ফোনে আমার কাছ থেকে জেনে নিও।
সে তো-জানবই। কিন্তু আমার অনেক হিসেব নিকেশ উলটে গেল।
কিছু উলটে যায়নি। এ বয়সে ওরকম মনে হয়। মন খারাপ কোরো না তো।
ঠিক আছে পিউদি।
শোনো, বেলা দুটো আড়াইটের সময় একবার এসো। আমি ব্যবস্থা করে রাখব, যাতে চুপটি করে রাখীকে দেখে যেতে পারবে।
ঠিক আছে। ধন্যবাদ।
বাবলু নার্সিং হোমের বাইরে এসে একবার বাড়িটার দিকে ফিরে তাকাল। চারতলা চমৎকার আধুনিক প্ল্যানিং-এর বাড়ি। তিনটে উইং। ভিতরে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতিতে সাজানো ব্যবস্থা। শোনা যাচ্ছে, আরও সব যন্ত্রপাতি আসছে। নিজের জ্যেষ্ঠপুত্র ডাক্তার নভোজিৎকে দেশে আটকে রাখার জন্যই তার বাবা বিশ্বদেব নার্সিং হোমটা করেছেন। বাবলুর এখনও বড়ো ডাক্তার হতে ঢের দেরি। তবে সে বিদেশেই সেটল করবে বলে ঠিক করে রেখেছে।
নার্সিং হোমের সামনে বিস্তীর্ণ বাগান। চমৎকার ফুল-টুল ফুটে আছে।
মাঝখানে চওড়া কংক্রিটের রাস্তা। অত্যন্ত দেখনসই ব্যাপার। নার্সিং হোমটা চলেও বেজায় ভালো। চট করে জায়গা পাওয়া যায় না।
বাবলু নার্সিং হোমটার দিকে কিছুক্ষণ অর্থহীন চেয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল।
বাড়িতে ঢোকবার মুখে পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল সে। পুলিশ এল নাকি?
বারান্দায় দু-জন সাদা পোশাকের অফিসার। এদের চেনে বাবলু। রমেন আর দীপক।
একটু থমকে বলল, কী হয়েছে?
রমেন গম্ভীর মুখে বলল, বড়োবাবু ভেতরে অপেক্ষা করছেন। যাও।
শিবদাসের চেহারাটা একটু রুক্ষ এবং শুষ্ক। বেশ লম্বা হাড়ে-মাসে চেহারা, উঁড়ো গোঁফ আছে। মুখে হাসি বা স্মিতভাব কখনও দেখা যায় না। চেহারার মতো স্বভাবটাও কেঠো এবং রসকষহীন। তবে হাঁকডাক নেই, রগচটা মানুষ নন, ঠাণ্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ।
অন্য সোফায় মা, বউদি আর স্বস্তিও বসে আছে। চুপ, উদ্বিগ্ন।
শিবদাস বললেন, তোর জন্যই বসে আছি।
কেন শিবদাসকাকু, কী হয়েছে?
তেমন কিছু নয়। কয়েকটা কথা জানার আছে। তবে এখানে নয়, একটু বাইরে চল।
মা উদ্বেগের গলায় বলে, কোনো চার্জ নেই তো।
শিবদাস উদার গলায় বলেন, আরে না, ওসব নয়। কতগুলো ক্লারিফিকেশনের ব্যাপার আছে। কিছু চিন্তা করবেন না। আধঘণ্টা বাদেই ফেরত আসবে।
বাবলু শিবদাসের পিছু পিছু গিয়ে জিপে উঠল।
থানায় নিজের ঘরে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে শিবদাস বলল, ব্যাপারটা কী রে?
কোন ব্যাপার?
তোর আর রাখীর মধ্যে কোনো অ্যাফেয়ার আছে নাকি?
বাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ছিল।
ছিল মানে, এখন নেই?
হ্যাঁ।
পরিষ্কার করে বল, তোদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে?
না। রাখী অ্যাভয়েড করছে।
কেন?
জানি না।
তুই কাল ঠিক কখন রাখীদের বাড়ি গিয়েছিলি?
বেলা দেড়টা-দুটো।
কী হয়েছিল? এনি শো-ডাউন?
না। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
কিন্তু রাখী তো বাড়িতে ছিল।
ছিল, কিন্তু দরজা খোলেনি, সম্ভবত কি-হোল দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়েছিল।
ভালো করে ভেবে দেখিস, কোনও খাড়াখাড়ি হয়েছিল কিনা, মেয়েটা তো অকারণে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করতে পারে না।
ও কেন এ কাজ করল আমি জানি না। বেশ কিছুদিন হল আমি ফোন করলে ও দু-একটা কাটাকাটা কথা বলে ফোন রেখে দেয়।