বুঝেছি। একটু বসুন, চা খান।
না না, ফর্মালিটির দরকার নেই। আপনি আমাকে অনেকটা সময় দিয়েছেন। ধন্যবাদ।
আরে মশাই। বসুন তো। কথা আছে।
অলোক উঠতে গিয়েও একটু হেসে বসে পড়ল।
আপনি পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেছেন। আমার কাছে খবর আছে যে, ওখানে একস্ট্রিমিস্টরা ডেরা বেঁধেছে। আপনি বিপদে পড়েননি?
অলোক ফের হাসল। বলল, দু-তিনবার বিপদ হয়েছে বটে, তবে একস্ট্রিমিস্টরা গোঁয়ার বা হ্যাঁবিচুয়াল খুনি নয়। তারা আমাকে দুবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের ডেরায়। চোখ বেঁধে এবং পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে। ভাগ্য ভালো যে তাদের আমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে পেরেছি।
আপনার প্রোটেকশন নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যে সাহসটা দেখিয়েছেন তাতে খুন হয়ে যেতে পারতেন।
আমাকে অন্যান্য জায়গাতেও এই সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খানিকটা অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয়, এরা কেউ সাইকোপ্যাথ কিলার নয়। প্রয়োজনে খুন করে ঠিকই, কিন্তু লোক বুঝে। আর প্রোটেকশন কে দেবে বলুন, এদের কাছে পুলিসও অসহায়। পাহাড় জঙ্গল ওরা নিজের করতলের মতো চেনে, পুলিশ চেনেনা। আমাকে মাঝে মাঝে এটুকু রিস্ক নিতেই হয়।
বিশ্বদেব হাসল, বলল, আপনার মতো বয়সে আমিও রিস্ক নিতে ভালোবাসতাম। কিন্তু আজকাল কেন যেন ভয় জিনিসটা বেড়ে গেছে। একটু আধটু রাজনীতি করি, সেটাই বোধহয় কাল হয়েছে। একটু চা খান। চা, না কফি?
যেকোনোটা। আমার নেশা নেই, চয়েসও না।
রিমোট কলিংবেল টিপে চায়ের সংকেত ভিতর বাড়িতে পাঠিয়ে দিল বিশ্বদেব। তারপর
বলল, আগামীকাল একবার আসতে পারবেন?
কখন বলুন।
সন্ধ্যের পর। ধরুন সাতটা বা সাড়ে সাতটা।
পারব।
আপনার কাগজপত্রও আনবেন। দেখি যদি ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে পারি।
ভাববেন, অবশ্যই ভাববেন। পৃথিবীর যে সংকট ঘনিয়ে আসছে তা নিয়ে সিরিয়াসলি আমাদের ভাবা উচিত। কয়লা, ডিজেল পোড়ানো, এসি চালানো, কলকারখানার অত্যধিক বিস্তার, গ্রিনহাউস গ্যাসের যত এমিশন হবে তত বাড়বে ওয়ার্মিং, তত বাড়বে পলিউশন, প্লিজ একটু ভাববেন।
বিশ্বদেব মাথা নেড়ে বলল, অবশ্যই।
চা নিয়ে এল বলরাম, এ-বাড়ির কাজের লোক, ট্রে টেবিলে রেখে বলল, মা একটু ডাকছেন আপনাকে।
বিশ্বদেব অলোকের দিকে চেয়ে বলল, আপনি চা খান, আমি এখনই আসছি।
বাইরের ঘরেই অপেক্ষা করছিল রুচিরা। বলল, ছেলেটা কে বল তো। কী চায়?
কেন? একটা কাজে এসেছে।
চেনো?
চিনতাম না, তবে চেনা হল।
হুটহাট অচেনা ছেলেছোকরার সঙ্গে দেখা করার দরকার কী? গুণ্ডার মতো চেহারা।
গুণ্ডা। কী যে বল। গুণ্ডার মতো হবে কেন?
কী জানি বাপু, স্বস্তি ঘুরে গিয়ে বলল, মা, দেখোগে যাও, বাবার সঙ্গে একটা গুণ্ডার মতো ছেলে দেখা করতে এসেছে।
দুর। ও একটা ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে। কিছু খারাপ নয়। আমি তো লোক চরিয়েই খাই, নাকি?
দেখো বাপু, দিনকাল ভালো নয় কিন্তু।
হঠাৎ ওকে দেখে স্বস্তি ভয় পেল কেন? ছেলেটাকে তো আমার বেশ ভালোই লাগছে, শিক্ষিত ছেলে, ভাবনাচিন্তা করে।
চেহারাটা দেখে অবশ্য খারাপ বলে মনে হচ্ছে না আমারও। স্বস্তি কী ভেবে বলল কে জানে।
রুচিরা ভিতরে চলে যাওয়ার পর বিশ্বদেব বারান্দায় এসে দেখে অলোক একইভাবে বসে আছে। চা ছোঁয়নি। গভীরভাবে অন্যমনস্ক।
চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে মশাই, খেয়ে নিন।
অলোক একটু চমকে উঠে বলল, হ্যাঁ, নিই।
আপনাকে কোনো সাহায্য করার দরকার হলে বলবেন, সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
তা জানি, এখানে সকলে আপনার প্রশংসাই করে। আপনি এ শহরের জন্য অনেক কিছু করেছেন।
কী আর করলাম বলুন। টাকা নেই, কো-অপারেশন নেই, কো-অর্ডিনেশন নেই, প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে করাপশন। ইচ্ছে থাকলেও ভালো কিছু করা প্রায় অসম্ভব। কনডিশন ফেভারেবল হলে এ শহরের ভোল আমি পালটে দিতে পারতাম।
চায়ের কাপটা রেখে অলোক বলল, এবার আমি আসি?
বিশেষ তাড়া আছে নাকি?
একটু আছে। নার্সিং হোমে একজনকে দেখতে যাব।
কোন নার্সিং হোম?
অলোক হেসে বলে, আপনার নার্সিং হোম।
ওঃ, কে বলুন তো?
হেডমিস্ট্রেস মৃন্ময়ী ভট্টাচার্যের মেয়ে রাখী।
বিশ্বদেব একটা ঢোঁক গিলে বলে, আপনি ওঁদের চেনেন?
সামান্য আলাপ আছে। দিদিমণি আমাকে কয়েকটা ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।
ও, আচ্ছা আসুন।
কাল আমি সন্ধ্যেবেলা কাগজপত্র নিয়ে আসব।
হ্যাঁ, আসবেন।
অলোক চলে যাওয়ার পর বিশ্বদেব খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
৩. নার্সিং হোমটার মালিক
নার্সিং হোমটার মালিক যদিও তার বাবা, তবু কর্মচারীরা সবাই চন্দ্রজিৎ ওরফে বাবলুকে চেনে না। সে কলকাতায় থাকে, এখানে এলেও কদাচিৎ নার্সিংহোমে আসে। সেটা একদিক দিয়ে রক্ষে।
সে রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়াল। এ শহরের সবচেয়ে নামজাদা এবং ব্যস্ত নার্সিংহোম। ফলে রিসেপশনে বেশ কয়েকজন লোকের জমাট ভিড়। একটু অপেক্ষা করে সে অবশেষে কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারল, আমি পিউ মজুমদারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
তরুণী রিসেপশনিস্ট খুব একটা পাত্তা দিল না, বলল, একটু অপেক্ষা করুন। উনি এখন রাউণ্ডে আছেন। সময়মতো খবর দেওয়া হবে।
আমি ওর কাছে যেতে চাই।
সেটা সম্ভব নয়। ভিতরে যাওয়ার নিয়ম নেই।
আমি একজন ডাক্তার, একটু বিশেষ দরকার ছিল। ওঁর সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
মেয়েটি ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, বলছি তো, রাউণ্ড শেষ হলেই খবর দেব।