আজ সকালের অবসাদ তাকে মর্নিং ওয়াকে পর্যন্ত যেতে উৎসাহিত করেনি। সকালে সামনের চওড়া বারান্দায় শীতের রোদে বেতের সোফায় বসেছিল সে। সামনে চমৎকার বাগান। গাড়ি-বারান্দাটি অর্ধচন্দ্রাকার, মোরামের রাস্তা চলে গেছে সামনের ফটক অবধি।
ফটক দিয়ে একটা লম্বা চেহারার ছেলে ঢুকল। পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে শার্টের ওপর জিনসেরই একটা জ্যাকেট। গালে ঘন দাড়ি আর গোঁফ আছে। এ-বাড়িতে লোকের অবারিত দ্বার। কারণ বিশ্বদেবের কাছে সারাদিন নানা কাজে নানা লোক আসে। ফটকে দারোয়ান মোতায়েন আছে বটে, কিন্তু কাউকে আটকানোর হুকুম নেই। শুধু ভিখিরিদের ঢুকতে দেওয়া হয় না, ফটক থেকেই তাদের পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয়। ছেলেটার ডান কাঁধে একটা ঝোলা, শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, যার স্ট্র্যাপ ডান হাতের মুঠোয় চেপে রেখেছে সে, বেশ বড়ো বড়ো সতেজ পদক্ষেপে ছেলেটা হেঁটে এসে বারান্দায় উঠল।
আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
বিশ্বদেব সামনের বেতের চেয়ারটা ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, বসুন।
ছেলেটার বয়স সাতাশ-আটাশ। মুখটা দেখে মনে হয়, খুব রোদে জলে ঘোরে। শরীরটা ছিপছিপে, শক্তপোক্ত, মাথায় অবিন্যস্ত লম্বা চুল। একনজরে দেখে ছেলেটার প্রতি বিরাগ অনুভব করল না বিশ্বদেব। বলল, বলুন।
আপনি আমাকে কতক্ষণ সময় দিতে পারবেন?
কেন, আপনার কি লম্বা কোনো কথা আছে?
হ্যাঁ, আসলে কথাটা শুধু আমার নয়। পৃথিবীর সব মানুষের।
বলেন কী? পৃথিবীর সব মানুষের কথা আপনি একা বলবেন?
ছেলেটা হাসল, তার দাঁতগুলোর সেটিং ভারি চমৎকার।
হাসিটি অতি সরল, বলল ভূমিকাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, মাপ করবেন। আসলে আমার বিষয় হচ্ছে জল।
জল। মাই গুডনেস? জল সম্পর্কে আমার কাছে কেন? যদি আপনার তেষ্টা পেয়ে থাকে, তাহলে অন্য কথা।
আমাকে একটু বুঝিয়ে বলতে দিন। আপনি নিশ্চিত জানেন যে, ধীরে ধীরে পৃথিবীর আবহাওয়া গরম হচ্ছে। গ্রিনহাউস এফেক্টের ফলে গ্লোব ওয়ার্মিং সম্পর্কে আজকাল পৃথিবী জুড়েই কথা হচ্ছে, দক্ষিণ মেরুর ওপরে ওজোন স্তরের ফুটো থেকেই আমাদের পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত।
হ্যাঁ জানি, সেজন্যে আমরা সবাই চিন্তিত।
বটেই তো। সবাই চিন্তিত, আর সেইজন্যেই আমি ঘুরে ঘুরে আমাদের জলের প্রাকৃতিক উৎসগুলি দেখছি। উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করলে সমুদ্রের জলস্তর ওপরে উঠবে, পৃথিবীর অনেক স্থলভূমি ডুবে যাবে, অনেক দেশ হয়ে যাবে নিশ্চিহ্ন, তেমনি বিপদ আমাদেরও। হিমালয় এবং অন্যান্য পর্বতমালার হিমবাহগুলি আমাদের বেশির ভাগ নদীর উৎস। হিমবাহগুলি গলে গেলে আমাদের নদীগুলিতে ভয়ংকর প্লাবন দেখা দেবে। একটা নদীর বদলে হাজারটা জলধারা সমভূমিকে প্লাবিত করে সমুদ্রে গিয়ে মিশবে। বিস্তর মানুষ মারা পড়বে। শহরগুলি ভেসে যাবে। কিন্তু তারপর আরও একটা ভয়ংকর বিপদ হবে।
সেটা কী?
হিমবাহ গলে প্রাথমিক প্লাবনের পর নদীগুলোর উৎস বলে আর কিছু থাকবে না। নদীর খাত যাবে শুকিয়ে। দেখা দেবে সাংঘাতিক জলসংকট। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী কুড়ি ত্রিশ বছরের মধ্যেই এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। হিমালয়ে বরফ বলে যদি কিছুই না থাকে, তবে কী হবে, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন।
পারছি। কিন্তু আপনি কী করতে চাইছেন?
সময় থাকতেই যাতে কতগুলি ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেইজন্যেই আমি বিভিন্ন মানুষের কাছে যাচ্ছি। ভবিষ্যতের ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমার কিছু প্রজেক্ট আছে। একটা হল যতটা সম্ভব সোর্সের কাছাকাছি বাঁধ দিয়ে হিমবাহের জল আটক করা। দ্বিতীয় প্রজেক্ট হল কয়েকটা নিকাশি খাল বের করা, আর হাইডেল তৈরি করা।
এসব নিয়ে পৃথিবীর বিশেষজ্ঞরা কি ভাবছেন না?
হ্যাঁ, অবশ্যই ভাবছেন, ধরে নিন আমার ভাবনাও তাঁদের প্রতিধ্বনি।
আপনি কি একজন বিশেষজ্ঞ? টেকনিক্যাল ম্যান?
না। আমি টেকনিক্যাল ম্যান বা অথোরাইজড পারসোনাল নই। তবে আমি একটি কোম্পানিতে চাকরি করি। কনসালটেন্সি ফার্ম, তাদের কাজই হল ডিজাস্টার অ্যান্টিসিপেট করে আগাম ব্যবস্থাপত্র তৈরি করা।
এসব বিগ প্রজেক্টের ব্যাপার, আমি কী করতে পারি বলুন। আমি একটা ছোট্টো শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান মাত্র।
সেটাও কম কথা নয়। আপনার শহরের ধার দিয়ে আর মাঝখান দিয়ে দুটো ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। এদের সোর্স পাহাড়ে। এই সোর্স আমি দেখে এসেছি। আমার মনে হয়েছে, সোর্সের দিকে মাইল দশেক ভেতরে একটা বড়ো ভ্যালি আছে। দু-দিকে পাহাড়, জলটা এখানে আটকাতে পারলে একটা বিশাল ন্যাচারাল বেসিন তৈরি করা যাবে, হাইডেল প্রজেক্টের পক্ষেও চমৎকার জায়গা।
ওটা আমার এলাকা নয়।
তাও জানি। আমি শুধু বলতে চাইছি, এই এলাকা আপনি খুব ভালো চেনেন। এই প্রোপোজালের এগেনস্টে কোথাও অবজেকশন উঠতে পারে কিনা, সেটা জানতেই আপনার কাছে আসা।
আপনার কোম্পানির নাম কী?
গ্লোবাল ফ্রেণ্ড ইনকরপোরেটেড।
নামটা চেনা ঠেকছে না।
নামটা শুনে প্রভাবিত হওয়ার মতো বড়ো কোম্পানিও নয়। তবে সরকার এদের অ্যাপয়েন্ট করেছে।
অ্যাপয়েন্ট করেছে মানে কি কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়ে গেছে?
না। আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমাদের কোম্পানি কিছু সাজেশন দেয়। সেটা অ্যাকসেপ্ট করা বা না-করা সরকারের মর্জি, সরকারি বাজেটেরও প্রশ্ন আছে।