তা তো হওয়ারই কথা, দাদা কী বলল শুনেছ তো? মৃন্ময়ী সন্দেহ করছেন অ্যাটেম্পটেড মার্ডার।
শুনলাম।
ভয় হচ্ছে, উনি আবার তোমাকে ফাঁসাতে চাইছেন না তো।
সেইজন্যেই রাখীর বেঁচে ওঠা দরকার। কিন্তু আমাকেই বা সন্দেহ করবেন কেন উনি? আমি তো রাখীকে ভালোই বাসি। খুনের প্রশ্ন উঠবে কেন?
মৃন্ময়ী ফ্রাস্ট্রেটেড মহিলা। ওঁদের মন সোজা পথে হাঁটে না।
রমেন ভট্টাচার্যকে তো তুমি দেখোনি বউদি।
না, ওঁদের ডিভোর্স হয় বোধহয় বারো-চোদ্দো বছর আগে। তবে শুনেছি, রমেন ভট্টাচার্য ভালো লোক ছিলেন।
হ্যাঁ, নিরীহ শান্ত মানুষ। পি.ডব্লু.ডি.-তে কাজ করতেন। খুব উঁচুদরের চাকরি নয়। লো প্রোফাইল ছিলেন। মৃন্ময়ী বরাবর ওঁকে ডমিনেট করতেন, শোনা যায় স্বামীকে মারধরও করেছেন। রাখী তখন খুব ছোটো। কিন্তু ওরও সেইসব অশান্তির কথা মনে আছে। ডিভোর্সের মামলা হওয়ার পর ভদ্রলোক একতরফা দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে রিজাইন দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
মৃন্ময়ী কি খুব খারাপ স্বভাবের মহিলা বাবলু? শুনতে পাই, উনি প্রচুর সোশ্যাল ওয়ার্ক করেন, দানধ্যানও আছে, ভালো গাইতে পারেন।
সেটাই তো মুশকিল হয়েছে বউদি, ওকে খলচরিত্রও বলা যাবে না। এ-শহরে ওর মানমর্যাদা কিছু কম নয়। সকলেই মৃন্ময়ীকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন। স্কুলটাকে প্রায় একার হাতেই এতটা বড়ো করে তুলেছেন।
সে তো জানি, কিন্তু মৃন্ময়ী দিদিমণি তোমাকে কেন অপছন্দ করেন সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি অত্যন্ত ব্রাইট ছেলে, বলতে নেই দারুণ হ্যাণ্ডসাম, স্মার্ট, ডাক্তার, পাত্রীর বাজারে এরকম ছেলে তো পড়তে পায় না। তাহলে মৃন্ময়ীর তোমাকে অপছন্দ কেন?
চন্দ্রজিৎ ওরফে বাবলু ম্লান হেসে বলল, উনি হয়তো মেয়ের জন্য আরও প্রসপেকটিভ পাত্র আশা করে বসে আছেন।
বাজে বোকো না। রাখীই-বা এমন কী মেয়ে? মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়। গুণও আছে। তা বলে হুরিপরি তো নয়, সাধারণ ঘরের আটপৌরে মেয়ে।
ঠিক তাই।
তোমার দাদাকে বলব?
না বউদি। সেটা ভালো হবে না। দাদা আমাদের মেলামেশার খবর হয়তো জানে না, তুমি যদি না বলে থাকো।
না, আমি বলিনি, তোমার দাদার সঙ্গে কথা বলার মতো বাড়তি সময় পাই নাকি? সপ্তাহে একবার-দুবার কলকাতায় অপারেশন করতে যায়, তার ওপর প্রায় সময়েই কনফারেন্সে হিল্লি-দিল্লি যাচ্ছে, বাকি সময়টা নার্সিং হোমে থাকতে হচ্ছে। দোষ দিচ্ছি না, ভালো সার্জনের ব্যস্ততা তো থাকবেই। ওই ফোন বাজল, বোধহয় নার্সিং হোম থেকে জরুরি কল।
যাই…
শর্মিলা ব্যস্ত হয়ে চলে যাওয়ার পর বাবলু উঠে বাতি নিবিয়ে দিল। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়, তারপর কী ভেবে উঠে সিডিতে একটা সেতার চালিয়ে দিয়ে ফের শুয়ে পড়ল।
একসময়ে সে সেতারের ভক্ত ছিল খুব। জীমূতবাহন নামে একজন সেতারি ছিলেন এ শহরে। নামজাদা লোক নন। তবে প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার পক্ষে চমৎকার। তাঁর কাছেই শিখত। জীমূতবাহন তার ভেতরে বড়ো সেতারি হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন বলে মন দিয়ে তালিম দিতেন।
কিন্তু বাবলু সময় দিতে পারল কই? ডাক্তারি পড়তে গিয়ে পড়ার চাপে সেতার বন্ধই হয়ে গেল একরকম। আজকাল হাসপাতালের লাগোয়া কোয়ার্টারে মাঝে মাঝে বাজায় বটে, কিন্তু সেই আবেগ আর নেই।
বাইরে গাড়ির শব্দ হল কি? হ্যাঁ, দাদা তাহলে নার্সিং হোমেই গেল।
কেন? রাখীর কি অবস্থা খারাপ?
তার মোবাইল ফোন তুলে সে নার্সিং হোমে ডায়াল করল।
পিউ মজুমদারকে একটু দেবেন?
একটু বাদে পিউ ফোন ধরল, বলো।
আমি বাবলু, দাদাকে কল করা হল কেন?
ভয় নেই। এটা অন্য কেস। রাখী স্টেবল আছে, ঘুমোও।
২. ঘুম কমে যাচ্ছে
ধীরে ধীরে ঘুম কমে যাচ্ছে বিশ্বদেবের। আটান্ন বছর বয়সে তার স্বাস্থ্য রীতিমতো পেটানো। মেদের বাহুল্য নেই। তেমন কোনো রোগ নেই। অসুখ-বিসুখ নেই। তবে হ্যাঁ, চিন্তা আর টেনশন যথেষ্ট আছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বদেব রীতিমতো যোগব্যায়াম করে, সকালে নিয়ম করে হাঁটে, নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সিটিং দেয় এবং দীক্ষা নেওয়ার কথাও সিরিয়াসলি ভাবছে। তার বউ রুচিরা একটু উন্নাসিক মহিলা। আর্ট, কালচার, মার্গসংগীত ইত্যাদি তার প্রিয় বিষয়। এ-শহরে তার একটা কালচারাল সেন্টার আছে। সেখানে আর্ট এগজিবিশন, পেইন্টিংয়ের এগজিবিশন, ফ্লাওয়ার শো, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার ইত্যাদি হয়ে থাকে। মফস্সল শহরে অবশ্য এগুলো তেমন ঢেউ তোলে না। তবে রুচিরা হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয়, ব্যবসায়ী এবং ধনী স্বামীটির চেয়ে সেরিব্রাল ব্যাপারে বা রুচিতে সে অনেক ওপরে। বিশ্বদেব স্ত্রীর এই অহংকারটুকু মেনে নেয়। সস্নেহ প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে। সত্যি কথাটা হল, রুচিরাকে আর তার প্রয়োজনই হয় না। রুচিরা তার মতো আছে থাকুক। বিশ্বদেব ভালোই জানে, তার বিপুল বৈভব রুচিরাকে যে শক্ত জমিটি দিয়েছে তার ওপর দাঁড়িয়েই ওর যত কালচার-গোঁড়ামি।
কাল রাতে ঘুম না হওয়ার কারণ হল রাখী। রাখী কেন মরতে চায় বা কে ওকে মারতে চায়, এটা নিয়ে অনেক রাত অবধি ভেবেছে সে। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তা ছাড়া কাল রাতেই সে আবছাভাবে বুঝতে পেরেছে, তার ছোটো ছেলে বাবলুর সঙ্গে রাখীর একটা ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক রচিত হয়েছে। সেটা যে কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না, এটাও তার দুশ্চিন্তার বিষয়। কাজেই আজ সকালে বেশ ক্লান্ত বোধ করছে বিশ্বদেব।