বাড়িতে তখন কেউ ছিল না?
না, মৃন্ময়ী ভট্টাচার্য তো ডিভোর্সি। মা আর মেয়ে থাকে। কাজের ঠিকে ঝি বিকেলে কাজটাজ করে চলে যাওয়ার পর রাখী একাই ছিল। ওর মা সন্ধ্যের সময় ফিরে কলিং বেল বাজিয়ে সাড়া পাননি। অথচ মাত্র মিনিট পনেরো কী কুড়ি আগেই নাকি মেয়ের সঙ্গে ফোনে ওঁর কথা হয়েছে। উনি জোর দিয়ে বলছেন, কথা বলার সময় উনি টের পেয়েছেন যে রাখীর সঙ্গে কেউ একজন আছে।
কে ছিল?
সেটা বলতে পারছেন না? ওঁর দৃঢ় বিশ্বাস এটা খুনের চেষ্টা।
তোরা, ডাক্তাররা কী বলিস?
সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাখীর মাথার পেছন দিকে একটা জায়গা ফুলে কালসিটে পড়েছে। ইনজুরি মারাত্মক নয়; তবে এমন হওয়া বিচিত্র নয় যে, কেউ মাথার পেছন দিকে শক্ত কিছু দিয়ে মেরেছিল। আবার বিষ খাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়ে থাকলেও ওরকম ইনজুরি হতে পারে।
অজ্ঞান হয়ে গেলে বিষ খাওয়ানো হল কেমন করে?
মুখে ঢেলে দিলেও হতে পারে। শিবদাসবাবু অবশ্য এসব জানতে চাইছেন না। তিনি সুইসাইড বলে হাত ধুয়ে ফেলতে চান। মেয়েটা বেঁচে উঠলে অবশ্য অন্য কথা।
শিবদাসকে মাথার চোটের কথা জানিয়েছিস?
হ্যাঁ, উনি পড়ে যাওয়ার থিয়োরিতে বিশ্বাসী। তুমি কি জানো মৃন্ময়ীর হাজব্যাণ্ড রমেন ভট্টাচার্য কোথায় আছে?
না, কলকাতায় তো ছিল।
বাবলু তার ঘরে আলো নিবিয়ে চুপ করে জানালার ধারে বসে ছিল। জানালাটা উত্তরে। খোলা জানালা দিয়ে প্রচন্ড ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে হুড়হুড় করে।
দরজায় টোকা দিয়ে বউদি চাপাস্বরে ডাকল, এই বাবলু!
বাবলু জানে, বউদি সহজে ছাড়বার পাত্রী নয়। বউদি মেয়েটা বড্ড ভালো। বোকা নয়, অতি চালাক নয়, স্বার্থপর নয়, মিশুকে এবং স্বভাবটি ভালো। এই জন্যেই বউদির সঙ্গে তার একটা ভারি মিষ্টি বন্ধুত্ব হয়েছে। সে উঠে নিঃশব্দে দরজাটা খুলে দিল।
জ্বালাতে এসেছ তো?
মোটেই নয়। খবরটা নিশ্চয়ই তুমি জানতে?
হ্যাঁ।
কখন জানলে?
সন্ধ্যেবেলাতেই। ওদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম।
কী সাহস! মৃন্ময়ী দিদিমণি তোমাকে আগের বার অত অপমান করার পরও? বাড়ি না গিয়ে বাইরেই তো দেখা করতে পারতে!
চেষ্টা করেছিলাম। রাখী কাল থেকেই ফোনে কাটাকাটা কথা বলছে। দেখা করতে চাইছে না।
ওমা! কেন? হঠাৎ ওর হল কী?
সেটা জানবার জন্যেই তো আজ মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন ছ-টা বেজে গেছে। দিদিমণি সাধারণত আরও একটু দেরিতে ফেরেন। আজ গিয়ে দেখলাম, বাড়িতে চেঁচামেচি, লোক জড়ো হয়েছে।
নার্সিং হোমে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ, গা-ঢাকা দিয়ে।
হঠাৎ সুইসাইড করতে গেল কেন?
করেনি। করার চেষ্টা করেছিল। নার্সিং হোমের পিউ মজুমদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, বেঁচে যাওয়ার চান্স আছে।
তোমার সঙ্গে কিছু হয়নি তো?
না বউদি।
তোমাদের মধ্যে কমিউনিকেশন আছে তো।
ছিল। দিনসাতেক আগে অবধি ফোনে রেগুলার কথা হত। দিনে অন্তত চার-পাঁচটা এস এম এস পেতাম। কিন্তু সাতদিন আগে হঠাৎ একদিন কমিউনিকেশনটা কেটে গেল।
কে কাটল? রাখী?
হ্যাঁ। ফোন করলে খুব আলতো দু-একটা কথা বলে লাইন কেটে দিত। নিজে ফোন করত না, এস এম এসও বন্ধ।
খুব স্ট্রেঞ্জ তো। একটা কারণ তো থাকবে।
সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার হঠাৎ এখানে আসার কারণও সেটাই। আমি জানতে চেয়েছিলাম হঠাৎ কী এমন হল, কিন্তু ও তো দু-দিন ধরে দেখাই করতে চাইছে না। তার ওপর আজ এই কান্ড।
ওর বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়েছিলে? তেমন কিছু প্রবলেম হয়ে থাকলে তো বন্ধুদের কাছে বলবে।
ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু নন্দিনী। কাল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলল, রাখী কোনো কারণে আমাকে কাটিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু কারণটা বলেনি। চাপা স্বভাবের মেয়ে, জানোই তো।
দাঁড়াও, আমি বরং কাল থেকে একটু গোয়েন্দাগিরি শুরু করি।
না বউদি, ব্যাপারটা চাউর হোক আমি চাই না, রাখী নিজেই হয়তো কোনোদিন বলবে। তুমি খোঁজখবর করতে গেলে মা যদি জানতে পারে, তবে খুশি হবে না।
জানি। মা রাখীকে হয়তো ততটা অপছন্দ করেন না, কিন্তু রাখীর মাকে করেন। তাঁর ধারণা রাখীর বাবার সঙ্গে ওঁর ডিভোর্সটা ওঁর দোষেই হয়েছে।
কোনো অজ্ঞাত কারণে মৃন্ময়ী দিদিমণিও মাকে পছন্দ করেন না।
সেটাও জানি। এখন তবে কী করবে?
কী করব বলো তো। আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না। তুমি নিজে তো একজন মেয়ে। বলো তো, একটা মেয়ে তার ভালোবাসার ছেলেটিকে হঠাৎ অপছন্দ করতে শুরু করবে কেন? যতদূর জানি, আমি তো কোনো দোষও করিনি।
মেয়েদের ভালোবাসা বেশ স্ট্রং হয় মশাই। ছেলেদের মতো তারা অত ছুঁকছুঁক করে বেড়ায় না। আর রাখী বেশ সিরিয়াস টাইপের মেয়ে।
এমনকী হতে পারে যে, হঠাৎ অন্য কারো প্রেমে পড়েছে?
দূর। ওসব নয়। বললাম তো, মেয়েরা অত সহজে পুরুষ বদল করতে পারে না। খুব স্ট্রং কারণ থাকলে অন্য কথা।
রাখীর ব্যাপারে আমার তো সে-রকমই কনফিডেন্স ছিল।
বিশ্বাসটা ভেঙে ফেলো না। আমাকে একটু ভাবতে দাও।
ভাবো। কিন্তু গোয়েন্দাগিরি করতে যেও না।
আচ্ছা ধরো, রাখী যদি তোমার ওপর ইন্টারেস্ট হারিয়েই ফেলে থাকে, তাহলে তুমি কী করবে?
তা জানি না, শুধু জানি আমি ওকে ভালোবাসি। মনে মনে একটা রচনা তো হয়ে আছে। কিন্তু যদি বুঝি যে, ও আমাকে আর সত্যিই চায় না, তাহলে পাগলও হব না, সুইসাইডও করব না। কষ্ট তো হবেই। খুব কষ্ট হবে।