তা খুব সত্যি।
বিষ খেয়েছিলাম, কিন্তু মরলাম না। কেন কে জানে! মরাও হল না, আবার এখন লোকের বিদ্রূপের পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার জ্বালা সইতে হবে।
ওসব কেন ভাবছেন? আমাদের কার জীবনে দুঃখ নেই বলুন তো, তবু বেঁচে থাকার জন্য কী না করতে হয় বলুন? মরলে জ্বালা জুড়োয় হয়তো, কিন্তু জীবনের সবটাই তো আর জ্বালা-যন্ত্রণা নয়। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য সুখ, অবাক করা অভিজ্ঞতাও তো হয়। মাস দুই আগে এক মহিলার খুব সেবা করেছিলাম। যাওয়ার সময় উনি আমাকে একছড়া সোনার হার দিলেন জোর করে। বললেন, তুমি প্রফেশনাল নার্স, কিন্তু মেয়ের মতো সেবা করেছ। আমার নিজের ছেলে বিদেশে থাকে, কেবল টাকা পাঠিয়ে খালাস। আপনজনরা তো আপন হল না, তুমি পর হয়েও আপনজনের মতো সেবা করলে।
রাখী চুপ করে শুয়ে রইল, কথা বলল না।
সকাল আটটার পর রমেন আর মৃন্ময়ী এল। মুখে একটু খুশির ভাব।
তোকে নাকি আজ বিকেলে ছেড়ে দেবে।
জানি না।
তার মাথায় হাত রেখে মৃন্ময়ী বলে, খুশি হোসনি?
রাখী চোখ খুলে স্লান একটু হেসে বলল, খুশি হব কেন? নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেলেই কি মুক্তি? কত কর্মফলের বন্ধন আমাদের আটকে রেখেছে, তা থেকে মুক্তি কোথায় বল!
মৃন্ময়ীর মুখটা শুকিয়ে গেল। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, আমার দোষ, আমার অপরাধ তো স্খলন হওয়ার নয় মা। কিন্তু মানুষ তো কত প্রতিকূলতা নিয়েও বাঁচে। রমেন অবধি আজ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর সঙ্গেই তো আমি সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম।
রাখী স্তিমিত গলায় বলে, তোমার দোষ বা অপরাধ নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না মা।
আমি শুধু ভাবি, আমার জন্ম অন্যের ইচ্ছাধীন, আমার কর্মফল অন্যের কর্মফলের পরিণতি, আমার স্বাধীন সত্তা বলে কিছু নেই। তাহলে আমরা স্বাধীনতার কথা বলি কেন? কত কত মানুষের রক্ত আমার শরীরে বল তো!
ওসব ভাবিস না মা। আমরা ঠিক করেছি, অন্য কোথাও চলে যাব। তোকে নিয়ে।
পালাবে? তা কেন মা? আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। এই শহরে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, এর প্রতিটি ইঞ্চি আমার চেনা। এ-জায়গা থেকে আমি পালাব কেন? যা সত্যি তার কাছ থেকে কি পালানো যায়? না সেটা উচিত?
মৃন্ময়ী আর রমেন পরস্পরের দিকে একবার তাকাল।
মৃন্ময়ী বলল, তাহলে কী করতে বলিস আমাদের?
কপালদোষে আমার দুটো বাবা, একজন জন্মদাতা, অন্যজন পালনকর্তা। জীবনটাকে নতুন ছকে, অন্য প্যাটার্নে আবার নতুন করে ভাবব মা। সে-জীবন অন্যরকম হবে, আর পাঁচজনের মতো নয়। আমি সত্যকে গোপন করব না, পালাব না, মরতে গিয়েও মরা যখন হল না, তখন নতুন আলাদা রকমের একটী জীবনযাপন করার চেষ্টা করতে হবে। তোমাকেও পালাতে দেব না, যা সত্য তা স্বীকার করে এখানেই থাকতে হবে তোমাকে, পারবে না? মৃন্ময়ী কাঁদছিল। মেয়ের মাথায় আরেকবার হাত রেখে বলল, পারব।