রমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে অনেক কথা! সব শুনতে চেও না। মেয়েরা যখন ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে, তখনই সংসারের ভিত আলগা হতে শুরু করে।
মৃন্ময়ী অত্যন্ত অ্যাকমপ্লিশড হেডমিস্ট্রেসবলে শুনেছি।
ঠিকই শুনেছ, তবে শি ওয়াজ নট দ্যাট অ্যাকমপ্লিশড হাউজওয়াইফ।
আপনি সেই পুরোনো মেল শোভিনিস্টের মত কথা বলছেন।
না রে ভাই, সংসার বা পরিবার যদি গুরুত্বহীন ব্যাপার হত তাহলে মানুষ চিরকাল নোম্যাডস থাকত। পরিবার তৈরি হয়েছিল গুরুতর প্রয়োজনেই।
ফের বিয়ে করলেন না কেন?
ভয় হয়েছিল, দাম্পত্য বোধহয় আমার সইবে না। আমি অচল মুদ্রা।
এখনও তাই ভাবছেন?
হ্যাঁ। তবে আমি মৃন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
করেছেন? সেটা আগে বলবেন তো!
মৃন্ময়ীর একটা ক্রাইসিস যাচ্ছে, জানো বোধহয়? ওর মেয়ে
অলোক অবাক হয়ে বলে, তার মানে? সে তো আপনারও মেয়ে!
কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে রমেন বলে, তোমাকে আমি খুব বিশ্বাস করি, তাই বলছি। মেয়েটি আমার নয়। কার তা জিজ্ঞেস কোরো না। কিন্তু মেয়েটাকে আমার কখনো ঘেন্না করতে ইচ্ছে হয়নি।
সরি ভট্টাচার্যদা, বোধহয় একটা সেনসিটিভ প্রসঙ্গ তুলে ফেললাম।
না যা সত্য তাকে কি আর চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায়? মেয়েটা কেন সুইসাইড করতে চেয়েছিল সেটা জানা দরকার। আরেকটা কথা, মৃন্ময়ীর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়াও হয়েছে।
সত্যি! কনগ্রাচুলেশনস।
ইট ইজ অ্যান অ্যাগ্রিমেন্ট ইন ক্রাইসিস। মৃন্ময়ীর বোধহয় এখন আমাকেই দরকার। আমারও দরকার মৃন্ময়ীকে। লাইক দ্যাট।
অন্যমনস্ক অলোক বলে, মানুষকেই তো মানুষের দরকার।
সন্ধ্যেবেলা নার্সিং হোমে রাখীর কেবিনে ঢুকল মৃন্ময়ী আর রমেন।
নার্স বলল, রাখীর আজ বিকেলে জ্ঞান ফিরেছিল।
মৃন্ময়ী : কিছু বলছিল?
হ্যাঁ, আজই প্রথম দু-একাটা কথা বলল। তবে বোঝা গেল না। শুধু দু-একবার বলল, ফোটো! ফোটো!
ফোটো! কীসের ফটো?
তা বলল না। কয়েকবার উঃ আঃ করেছিল। প্রায় দশ মিনিটের মতো জ্ঞান ছিল। তারপর ফের আগের অবস্থা।
মৃন্ময়ী রমেনের দিকে চাইল। রমেন মাথা নেড়ে জানায়, সেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।
কিছুক্ষণ রাখীর পাশে বসে তারা পরস্পর কথা বলল। রাখীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, রাখীর ছেলেবেলার কথা।
বেরিয়ে আসার পর মৃন্ময়ী বলল, হোটেলে না-থেকে বাড়িতেই এসে থাকো না কেন? আমি যে ভরসা পাই।
সেটা কি ভালো দেখাবে মৃন্ময়ী?
খারাপই বা দেখানোর কী আছে? আমরা তো স্বামী-স্ত্রীই ছিলাম। আবার হয়তো তাই হব।
তুমি এ-শহরের মান্যগণ্য মহিলা। তোমার কোনো বদনাম হলে দুঃখের ব্যাপার হবে। স্বামী-স্ত্রী হতে গেলে লোককে জানিয়েই হওয়া ভালো।
তাই হোক, দিনের কিছুটা সময় আমার কাছে থেকো। কী জানি, কেন তুমি আসার পর আমি প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তুমি আসায় বেঁচেছি। জোর পাচ্ছি।
লোকে তোমাকে প্রশ্ন করছে না আমাকে নিয়ে?
না। লোকে তো রাখীর কথা জানে, তাই আমাকে বেশি বিরক্ত করতে চায় না। স্কুল থেকে ছুটিও নিয়েছি। ফোটোর কথা কেন বলছিল বলো তো!
বুঝতে পারছি না। খুব সংকোচের সঙ্গে, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে?
করোই না।
খারাপ ভাবে নিও না। অদম্য কৌতূহল থেকে বলছি।
বলো। কিছু খারাপ ভাবব না।
রাখীর সঙ্গে বিশ্বদেবের মুখের আদল ভীষণভাবে মিলে যায়, তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু ওকথা কেন?
জানতে চাইছি, এ-ব্যাপারে কেউ কি মিলটা লক্ষ করে তোমাকে কিছু বলেনি কখনো?
না। লোকে অত লক্ষ করে না আজকাল। আর মিলটা বোধহয় এখন আর ততটা নেই। রাখী বড়ো হওয়ার পর ওর চুল বড়ো হয়েছে, ভ্রূ প্লাক করে, মেকআপ নেয়। না, এখন চট করে আদল ধরা যায় না, খুব মন দিয়ে লক্ষ না করলে।
লোকে লক্ষ না করুক, রাখী কি লক্ষ করেছে?
না। রাখী আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলে। লক্ষ করলে বলত।
সেটাই বাঁচোয়া।
ভোর বেলা রাখী চোখ মেলেই বাবলুকে দেখতে পেল। চমকাল না, অবাক হল না। ব্যথাতুর মুখে একটু হাসল।
কেমন আছ রাখী?
ভালো।
আমি তোমার জন্যে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আমি ভালো আছি। বলেই ফের চোখ বুজল রাখী।
তোমার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার ছিল।
রাখী চোখ খুলল না। নিস্তেজ গলায় বলল, এখন কোনো কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমি একটু চুপচাপ থাকতে চাই, তুমি এখন যাও।
যাচ্ছি। কিন্তু আমার কথাও একটু ভেব। আমি যে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি।
জীবনে যা কিছু ঘটে তার সব কিছুর লাগাম আমাদের হাতে নেই। অন্যের পাপ এবং তার ফল আউট আমাদের বহন করতে হয়। তুমি যাও বাবলু, কে কোন খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভাবনার কোনো আগ্রহ নেই আমার। দয়া করে চলে যাও।
একটি অল্পবয়সী নার্স ঘরে ঢুকে বাবলুকে দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল, এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়। আপনি কী করে ঢুকে পড়লেন।
রাখী চোখ না খুলেই একটু টেনে টেনে বলল, রুপু, উনি হলেন নার্সিং হোমের মালিকের ছেলে। ওঁর নিয়ম-কানুন মানবার দরকার হয় না। বরং আপনার চাকরি যেতে পারে।
নার্সটি থতমত খেয়ে বলল, ওঃ সরি। আমি তো আপনাকে চিনতাম না।
বাবলু গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল।
রুপু গরম জলে তুলো ভিজিয়ে রাখীর মুখ স্পঞ্জ করতে করতে বলল, চোখে জল কেন?
চোখের জলের পেছনে অনেক কারণ আছে রুপু। জীবন যে কত অদ্ভুত খেলা দেখায়!