আপনি তো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন মশাই!
হ্যাঁ, আমরা সাধারণ মানুষরা তো ভয় পাচ্ছিই, কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানরা যে পাচ্ছেন না। আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ মানতে চায় না, ইউরোপ মানতে চায় না, পশ্চিম এশিয়া মানতে চায় না। এই পশ্চিমবঙ্গেই তো ইণ্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন যত ইণ্ডাস্ট্রি তৈরি হবে ততই জমি, তৃণভূমি, জঙ্গল লোপাট হবে, ততই ক্ষতি হবে পৃথিবীর।
আপনি জল নিয়ে কাজ করেন শুনেছি।
হ্যাঁ, জল আমাদের বন্ধু, আবার শত্রুও।
আপনি কি সায়েন্টিস্ট?
মৃদু একটু হেসে অলোক বলল, সায়েন্টিস্ট বললে বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। যেটুকু সায়েন্স জানলে চাকরিটা বজায় রাখা যায় সেটুকু জানি। আমরা উদ্বাস্তু, গরিব, বাবা আমাকে যথাসাধ্য লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যতটা সচ্ছলতার প্রয়োজন ছিল, তা তো আমাদের ছিল না। ফলে লেখাপড়া বারবার বাধা পেয়েছে।
গ্লোবাল ফ্রেণ্ড ইনকরপোরেটেড কি খুব বড়ো কনসার্ন?
হ্যাঁ। বিগ কনসার্ন।
টেকনিক্যাল লোক না হয়েও আপনি এখানে চাকরি পেলেন কীভাবে?
সে একটা মজার গল্প।
মজার গল্প? মজার গল্প শুনতে আমরা সবাই ভালোবাসি।
বিশ্বদেব এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সেও বলল, হ্যাঁ, মজার গল্পটা শুনিয়ে দাও।
অলোক বলল, রসায়নে এম.এস.সি. পাশ করে আমি একটা ছোটো মফস্সল শহরের কলেজে অধ্যাপনা করতাম। কিন্তু অধ্যাপনা মানেই সিলেবাসে আটকে যাওয়া। বিশ্বের বিজ্ঞানে রোজ নতুন নতুন থিয়োরি আসছে, পুরনো সংজ্ঞা পালটে যাচ্ছে, কত কী আবিস্কার হচ্ছে। অধ্যাপনার জালে আটকে গিয়ে আর সেসবের খবরই রাখা হচ্ছিল না। তবে পাগলামিবশত আমি বিদেশি জারনালে আমার নানা ভাবনাচিন্তার কথা লিখে পাঠাতাম। বেশির ভাগই ছাপা হত না। তবে একটা-দুটো বেরিয়েও যেত। গ্লোবাল ফ্রেণ্ডেরও বেশ কয়েকটি পত্রিকা বেরোয় আমেরিকায়। আমি তাদের পত্রিকাতেও লেখা পাঠাই। রিসার্চ গ্রুপের এক কর্তা হঠাৎ আমাকে একটা চিঠি লিখে জানালেন যে, তিনি কলকাতায় আসছেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলে খুশি হবেন। আমি গিয়েছিলাম। দেখলাম, ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ, প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ। আমার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গল্প করলেন। তার মধ্যে তিনি বারবার আমার ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলেন। আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে, উনি আসলে আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। শেষে আমাকে বললেন, আমাদের কোম্পানি কিছু পাগলকে রিক্রুট করতে চায়, যেসব পাগলের চিন্তার ধারা কোনো পূর্বসিদ্ধান্তের দ্বারা শৃঙ্খলিত নয়। মনে আছে তিনি ওয়াইল্ড থিংকার শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন।
তারপরই চাকরি?
প্রায় বারো মাস বাদে আমাকে চাকরি দেওয়া হয়।
কোথায় জয়েন করলেন?
সিয়াটলে।
সেখানেই সেটল করবেন?
জানি না। তবে থাকা তো আর হয় না। যেখানে যেখানে কোম্পানি কাজ পায়, সেখানেই ছুটতে হয়।
আর আপনার মা? তিনি কোথায় থাকবেন?
মায়ের কথা আর কী বলব। আমি কুপুত্র, তাই এই বুড়োবয়সে, যখন আমাকে তাঁর সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন আমি তাঁর কাছে থাকতে পারি না। আর আমাকে ছাড়া মা-ও বড় অসহায় বোধ করত। সেইজন্য মাকে আমি সিয়াটলে একটা দোকান করে বসিয়ে রেখেছি। ছোটো গ্রসারি শপ এখন দেখছি, এই বাষট্টি বছর বয়সে মা দোকানটা নিয়ে দিব্যি মেতে আছেন। দোকান থেকে এক ব্লক দুরে আমাদের বাড়ি। কাজেই গাড়ি চালাতে না জানলেও মা-র অসুবিধে হয় না।
আপনি গ্রিনকার্ড হোল্ডার না সিটিজেন?
গ্রিনকার্ড। সিটিজেন হওয়ার ইচ্ছে নেই।
ফিরে আসার ইচ্ছে আছে তাহলে?
যাওয়া বা ফেরার কথা ভাবি না। আমি তো সারা দুনিয়ায় দৌড়ে বেড়াচ্ছি। যাওয়া বা ফেরা কোনোটাই বুঝতে পারি না। আর এই ছোটাছুটি করতে করতে কোনো বিশেষ দেশ নয়, পৃথিবীটাকেই আমার বড় ভালো লাগে। গোটা পৃথিবীটাই যেন আমার দেশ।
বিশ্বদেব বলল, দ্যাটস এ নোবেল থট। আসলে পৃথিবীটাই তো আমাদের দেশ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা ছোটো করে ভাবি বলে যত গন্ডগোল।
হঠাৎ টুলুর দিকে চেয়ে অলোক বলল, আপনার রুগির কী খবর?
রুগি! কে রুগি বলুন তো!
আমি রাখীর কথা জিজ্ঞেস করছি।
রাখী ঠিক আমার আণ্ডারে নেই। মেডিসিনের লোকদের আণ্ডারে আছে। তবে অপারেশনের দরকার হলে অন্য কথা। কেন, আপনি কি রাখীকে চেনেন নাকি?
ঠিক সে-রকম চেনা নয়। উনি একটা দলের সঙ্গে পিকনিক করতে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। আমরা তখন সেখানে তাঁবু মেলে কাজ করছিলাম। উনি কৌতূহলী হয়ে এসে আলাপ করেন।
শুধু আলাপ?
হ্যাঁ। উনি আমাদের মোড অফ অপারেশনস জানতে চেয়েছিলেন।
এটা কবেকার ঘটনা?
মাস খানেক আগে। তখনই মনে হয়েছিল কোনো কারণে উনি খুব আপসেট। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন।
টুলু অবাক হয়ে বলল, কেন আপসেট তা বলেছিল?
নট ইন সো মাচ ওয়ার্ডস। সদ্য চেনা কাউকে বলবেই বা কেন? আমিও ভদ্রতাবশে কৌতূহল দেখাইনি। শুধু বলেছিলাম, ওয়াচ ইওর স্টেপস। আপনি খুব আনমাইণ্ডফুল আছেন। উনি বলেছিলেন, হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা।
আর কিছু নয়?
না। শুধু বলেছিলেন, একজন লোক ওর জীবনটাকে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কারো নাম বলেননি।
মাই গড! এসব তো আমরা জানতাম না।
.
খাওয়ার পর অলোক বিদায় নিতেই স্বস্তি ঘোষণা করল, লোকটা চালিয়াৎ, মোটেই সত্যি কথা বলেনি।