কিন্তু ওকে যদি হাসপাতালে শিফট করে?
দেখা যাক। শিবদাস অবিবেচক লোক নয়। ইচ্ছে করলে ওরা নার্সিং হোমে সিপাই রাখতে পারে। আমার আপত্তি নেই। এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই আয়।
আমি ওকে চিনি। যদিও আলাপ নেই।
আলাপ কর না। ও হচ্ছে
জানি। তোমার কাছেই তো শুনেছি! রাখীর কাছেও।
অলোক মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, রাখীর সঙ্গে আমার একটা চান্স মিটিং হয়ে যায়, তারপর উই বিকেম ফ্রেণ্ডস।
রাখী আপনার কথা আমাদের কাছে বলেছে। আপনি নাকি খুব মিশুক মানুষ।
তা বলতে পারেন। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করারই চেষ্টা করি। আমরা যে গ্লোবাল ফ্রেণ্ডস।
আপনি রাখীর বন্ধু, রাখী কেন সুইসাইড করার চেষ্টা করল তা জানেন?
সেটা তো আমার জানার কথা নয়।
আন্দাজ করতে পারেন না?
না। উই আর নট দ্যাট ক্লোজ।
রাখী কিন্তু অন্য কথা বলে।
স্বস্তির গলা উপরে চড়ছে দেখে বিশ্বদেব অস্বস্তি বোধ করে বলে, ও কী স্বস্তি? তুমি কি রাখীর কারণে একে চার্জ করছ নাকি? ভুলে যেও না, অলোক আজ আমাদের অতিথি।
স্বস্তি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, সরি বাবা। আই অ্যাপোলোজাইজ। যাচ্ছি।
বলে স্বস্তি এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
বিশ্বদেব বলল, কিছু মনে কোরো না অলোক। আমার ছোটো মেয়ে একটু মুডি।
না। মনে করার কী আছে। উনি হয়তো আর কিছু ভেবে নিয়েছেন। রাখী ভালো মেয়ে।
খুব তেজিও। জানো বোধহয়!
রাখীর সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশিদিনের নয়। পাহাড়ে একদল মেয়ে পিকনিক করতে গিয়েছিল, আমি তখন তাঁবুতে থাকতাম। সেই সময়ে হঠাৎ আলাপ হয়। আমার মিশন জেনে উনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন। খুব ইন্টেলিজেন্ট প্রশ্ন। তারপর কয়েকবার বাড়িতে চা খেতে ডাকেন। এভাবেই একটা চেনাজানা তৈরি হয়ে যায়। আপনার মেয়ে হয়তো মনে করে সম্পর্কটা তার চেয়েও গভীর কিছু।
তাহলেই বা ক্ষতি কী?
ক্ষতি আছে।
কী ক্ষতি অলোক?
আমি ঠিক ওরকম নই।
তোমাকে দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি লঘুচিত্ত নও। তুমি একজন ডেডিকেটেড ভলান্টিয়ার। এ কারেজিয়াস ম্যান। ইগনোর স্বস্তি, ওর কথায় কান দিও না।
ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি।
একটু বাদে খাওয়ার টেবিলে যখন দেখা হল তখন স্বস্তির মুখখানা থমথমে, তবে সে অলোককে উপেক্ষার ভাব দেখাল না। প্রথমেই বলল, জানেন তো আপনার সম্মানে আমরা সবাই আজ নিরামিষ খাব।
অলোক বিস্মিত হয়ে বলল, তা কেন? আপনারা মাছ-মাংস খেতেই পারেন।
নাঃ, আপনার একটা সম্মান আছে না?
আছে বুঝি! বলে অলোক হো হো করে হাসল।
আর লজ্জায় রাঙা হয়ে কুঁকড়ে গেল স্বস্তি।
টুলু খুব মন দিয়ে লক্ষ করছিল অলোককে। বলল, আপনি সিয়াটলে থাকেন?
ওটা আমার আস্তানা বলতে পারেন। কিন্তু থাকা আর হয় কই? কেবল ছোটাছুটি করে বেড়াতে হয়।
কোথায় কোথায় যেতে হয় আপনাকে?
যেখানে জল সেখানেই আমি। খাল, বিল, সমুদ্র, গ্লেসিয়ার, প্রাইমা ফ্রস্ট সবই আমার বিষয়।
জল নিয়ে গবেষণাটা কী ব্যাপার বুঝিয়ে বলবেন?
জলই তো ভবিষ্যতে সমস্যা হয়ে উঠবে। অতি-জল এবং জলহীনতা। ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েকটা দেশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ডাঙায় দেখা দেবে জলকষ্ট। আবহাওয়া যাবে পালটে, এই ওলটপালটের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস। সভ্যতার বেহিসেবি অগ্রগমনের খাজনা দিতে হবে মানুষকে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ব্যাপার তো!
হ্যাঁ। ঠেকাতে পারবেন?
মানুষের চৈতন্য হলে ঠেকানো যাবে।
আপনি যে দেশে থাকেন সেই আমেরিকাই তো সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে ছাড়ে।
হ্যাঁ। তারা কোনো নিয়ন্ত্রণ মানতে চায় না। ভোগবাদ টসকালে তারা বিগড়ে যায়।
আপনি প্রাইমা ফ্রস্টের কথা বললেন। কিন্তু সে তো শুধু পোলার রিজিয়নে পাওয়া যায় শুনেছি। তার মানে আপনি পোলার রিজিয়নেও গেছেন?
না গেলে চলবে কেন?
তার মানে গেছেন?
হ্যাঁ।
কোনটাতে?
অলোক মৃদু হেসে বলে, দুটোতেই।
এবং অনেক বার।
মাই গড!
পৃথিবীর যথার্থ অবস্থা বুঝতে গেলে দুটো পোলেই যাওয়া দরকার।
গিয়ে কী বুঝলেন?
আমি তো একা যাইনি। টিমের সঙ্গে গিয়েছিলাম। দলে অনেক বিশেষজ্ঞ ছিলেন। নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়েছে। আমার কাজ ছিল কিছু অ্যানালাইসিস।
তাঁবু খাঁটিয়ে থাকতে হত?
দক্ষিণমেরুতে অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে। খুব সাবধানে চলতে ফিরতে হয়। কোনো জন্তু জানোয়ারের কাছে যাওয়া যায় না, কোনো বর্জ্য ফেলা যাবে না। এমনকী স্পিটিং-ও চলবে না। একজন মুখের চুইংগাম ফেলেছিল বলে তাকে দেড় ঘন্টা ধরে সেটা খুঁজে বের করে পকেটস্থ করতে হয়েছিল। আমরা জাহাজে থাকতাম, তবে মোটোর স্লেড-এ করে অনেকটা ভেতরে যেতে হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একটা স্থায়ী ক্যাম্পও ওখানে আছে। সেখানেও কিছুদিন থেকেছি। অ্যান্টার্কটিকা ইজ এ ম্যাগনিফিসেন্ট প্লেস।
আর ঠাণ্ডা?
সাংঘাতিক। ঈশ্বরের কাছে আমাদের সকলের প্রার্থনা, আর্কটিকা বা অ্যান্টার্কটিকা যেন কখনো তার শীতলতা না হারায়, বরং আরও শীতল হয়। পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য তাদের ঠাণ্ডা থাকা দরকার।
এসব আমরা কিছু কিছু জানি। আপনার কোম্পানি এর অ্যান্টিডোট হিসেবে কী করতে চায়?
শুধু আমাদের কোম্পানি কেন, পৃথিবীর বহু সায়েন্টিস্ট এবং সায়েন্টিফিক অর্গানাইজেশন কাজ করছে। কিন্তু হিউম্যান হ্যাবিটস এবং বিহেভিয়র নিয়ন্ত্রিত না হলে কিছুই হওয়ার নয়। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে, বিশেষ করে থার্ড ওয়ার্ল্ডে হিউম্যান হ্যাঁবিট্যাট বাড়ছে, নগরায়ণ হচ্ছে, জঙ্গল সাফ করা চলছে। এমনকী ব্রাজিলের রেইন ফরেস্ট-ও রেহাই পাচ্ছে না। এর ফল ভয়াবহ। এখনও যদি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, গাছ কাটা বন্ধ না করা যায় তাহলে পৃথিবীর সাংঘাতিক বিপদ। ম্যালথাসের থিওরি অনুযায়ী প্রকৃতিই নির্মমভাবে লোকক্ষয় ঘটিয়ে ভারসাম্য আনবে। আমরা প্ল্যান করে জনসংখ্যা যদি না কমাতে পারি তাহলে প্রকৃতিই তা করবে, তবে সেটা ঘটবে অতি নিষ্ঠুরভাবে।