অলোক একটা বেতের সোফায় বসে বলল, আমি এমন কিছু ইম্পর্ট্যান্ট লোক নই যে, আমার জন্য আপনি বারান্দায় বসে অপেক্ষা করবেন।
বারান্দাটা আমার খুব প্রিয় জায়গা। এখান থেকে বাগনটা দেখা যায়। সারাদিন মানুষ চরিয়ে এসে একটু নির্জনে বসতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, আপনি যা ব্যস্ত মানুষ।
আজকাল ভাবি এত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে না পড়লেও পারতাম। পৌরসভা, ব্যবসা, নার্সিং হোম, সভাসমিতি। এখন বোরিং লাগে। তোমার মতো একটা কাজ নিয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। পৃথিবী নিয়ে আর কতজন ভাবে বল। আমার ভাবনার দৌড় বড়োজোর এই শহরটা।
এ শহরটা নিয়েও তো কাউকে ভাবতে হবে। সবাই পৃথিবীর সংকট নিয়ে ভাবতে গেলে তো চলবে না।
সেও ঠিক কথা। তোমার কাজের কতদূর?
কাজ! সে তো অনন্ত। কাজের কোনো শেষ নেই।
তোমার সার্ভে শেষ হয়েছে?
প্রফেশনাল সার্ভেয়াররা কাজে নেমেছেন। পাহাড় জঙ্গল ঘুরে সার্ভে এবং ম্যাপিং বেশ। কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর ম্যানপাওয়ারও দরকার। আমরা গ্রামবাসীদের কিছু কাজে লাগিয়েছি। হঠাৎ রোজগারের সুযোগ পেয়ে তারা খুব খুশি।
আর উগ্রপন্থীরা?
আমরা তাদের অ্যাডভাইজার হিসেবে রাখছি। পার্টি ফাণ্ডে চাঁদাও দেওয়া হয়েছে। তারাও আপত্তি করছে না।
তোমার কিন্তু দুর্জয় সাহস।
না না। এসব হ্যাজার্ড সর্বত্র আছে। আমরা নেগোশিয়েট করতে শিখেছি। আমাদের তো পলিটিক্যাল অবলিগেশন নেই। সেই দিক দিয়ে গ্লোবাল ফ্রেণ্ড কারা শত্রু নয়।
আমি ইন্টারনেট থেকে তোমাদের কোম্পানির কথা জেনেছি।
ভালো করেছেন।
তোমার সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছি।
অলোক হেসে বলল, বেশ করেছেন। নেওয়াই উচিত।
তুমি আমেরিকায় থাক, বলনি তো?
বলার মতো কিছু নয়। কাজের জন্য থাকতে হয়।
বিয়ে করেছ?
না, আমি বিয়ে করলে বউ পালিয়ে যাবে। কারণ তার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ এতই কম হবে যে, বাড়ি ফিরলে সে আমাকে হয়তো প্রথমে চিনতেই পারবে না। আমার মায়ের বয়স এখন বাষট্টি। আমি কুপুত্র বলে মায়ের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রায় ছিলই না। আমার দুই দাদা আর দিদি বাইরে থাকেন। মা তাদের কাছেও যেতে চান না। অবশেষে চন্দননগরের বাড়িটার একতলায় ভাড়াটে বসিয়ে মাকে প্রায় জোর করে সিয়াটলে নিয়ে গেছি।
একা থাকতে পারেন?
সেটাই তো প্রবলেম ছিল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে মাকে এই বুড়ো বয়সে একটা দোকান করে দিয়েছি। গ্রসারি শপ। বাড়ি থেকে এক ব্লক দূরে। আশ্চর্যের বিষয় মা কিন্তু দোকান পেয়ে মহা খুশি। গাড়ি লাগে না, সকালে ব্রেকফাস্ট করে দোকানে গিয়ে বসেন। খদ্দের সামলান, এবং ব্যাপারটা এনজয় করেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
বিশ্বদেব হেসে বলল, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে।
প্র্যাকটিক্যাল বলতে পারেন।
চা খাবে?
আমার কিন্তু চায়ের নেশা নেই।
ড্রিংক কর?
না।
তাহলে শুধু কাজের নেশা?
আমার কাজটা ইন্টারেস্টিং।
এখানে তোমার থাকা খাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে না তো?
অসুবিধে যেটা হয় তার কারণ আমি ভেজিটেরিয়ান।
সে কী? আগে বলনি কেন? আজ তো বোধহয় আমাদের বাড়িতে মাংস আর মাছের আইটেমই হয়েছে।
নো প্রবলেম। আমি ডাল ভীষণ ভালোবাসি। ডাল ভাতই যথেষ্ট।
দূর পাগল! দাঁড়াও ভিতরে গিয়ে খবর দিয়ে আসি।
আমি সিম্পল খাওয়াই পছন্দ করি। একটু অসুবিধে হয় ট্রাইবাল এরিয়ায়।
তুমি ভেজিটেরিয়ান কেন?
বাই চয়েস। আমার পশু-পাখি খেতে ইচ্ছে করে না।
এ নোবল কজ!
বলতে পারেন। তবে অনিচ্ছেটা জেনুইন।
দাঁড়াও বাপু, গিন্নিকে বলে আসি। নইলে ডিনার টেবিলে উনি লজ্জায় পড়বেন।
কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে বিশ্বদেবকে আহাম্মক বনতে হল। শর্মিলা মৃদু হেসে বলল, উনি যে ভেজিটেরিয়ান সে তো আমরা জানি।
জানো! কী করে জানো?
শমির্লা হেসে কুটিপাটি হয়ে বলল, স্বস্তি খবর এনেছে।
আহা, স্বস্তিই বা জানবে কী করে?
রুচিরা গম্ভীর হয়ে বলে, কেউ ওকে বলেছে হয়তো। তুমি ব্যস্ত হোয়ো না, তোমার অতিথির সম্মানে আজ আমাদের পুরো ভেজিটেরিয়ান ডিনারই হচ্ছে। আর তাতে আমাদের তেওয়ারি ভীষণ খুশি।
যাক, একটা দুশ্চিন্তা গেল।
ফের বরান্দায় ফিরে এসে বিশ্বদেব দেখল, অলোক নিঝুম হয়ে বসে আছে।
কী ভাবছ?
কিছুই না।
বোধহয় গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা!
সেটা ভাবতে হয় না, সর্বদাই মনে একটা ভয়ের মতো বাস করে। তুমি বরং একটা সফট ড্রিংক নাও। শুধু মুখে বসে থাকছ ভালো দেখাচ্ছে না।
ব্যস্ত হবেন না। অনেক জায়গায় আমাদের দিনের পর দিন খাবার জোটে না। সফট ড্রিংকস আপনারাও খাবেন না। আল্টিমেটলি ওতে চিনি ছাড়া কোনো বিভারেজই থাকে না।
জানি। তবু তো সবাই বোতল বোতল খাচ্ছে।
তা ঠিক। তবে দেশে আগে যে সোড়া বা লেমোনেড পাওয়া যেত তা অনেক ভালো ছিল।
ঠিকই বলেছ। সেই স্বাদ ভোলার নয়।
ফটক খুলে একটি মেয়ে ঢুকল।
স্বস্তি! কোথায় গিয়েছিলি?
একটি নীল চুড়িদারে স্বস্তিকে দারুণ দেখাচ্ছে। মুখে তেমন কোনো দৃশ্যমান প্রসাধন নেই, বাঁ-হাতের কবজিতে একটা পুরুষালি ঘড়ি ছাড়া কোনো আভরণও নেই। মিষ্টি গলায় বলল, নার্সিং হোমে। রাখীকে দেখে এলাম।
ও। কেমন দেখলি?
তুমি তো গিয়েছিলে আজ, পিউদি বলছিল।
হ্যাঁ
একটু একটু তাকাচ্ছে কিন্তু। মনে হয় বেঁচে যাবে, না?
বাঁচবে।
ডাক্তাররা তোমাকে বলেছে?
হ্যাঁ। বয়সের জোর তো আছে, কমপ্লিকেশন কাটিয়ে উঠবে।