দুটো ব্যাপার বলছি। মন দিয়ে শোনো। ওর সঙ্গে রাখীর চেনা আছে। পিকনিক করতে গিয়ে ওদের পরিচয় হয়। দু-একবার বাড়িতে এসেছে। ছেলেটাকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল।
হ্যাঁ, ভালো লাগার মতোই তো ছেলে।
কিন্তু তুমি কি জানো যে, রমেন ভট্টাচার্য ওর বস!
সে কী? রমেন তো সরকারি চাকরি করত।
আমরা তো আর তার খোঁজ রাখিনি। রমেন অবশ্য বরাবর ভালো ছাত্র ছিল। নকশাল হয়ে পড়াশুনো ছাড়ে। ডিভোর্সের পর নাকি চাকরি ছেড়ে পড়াশুনো শুরু করে। বিদেশে গিয়ে পি.এইচ.ডি. করেছে। এখন গ্লোবাল ফ্রেণ্ডে বড়ো চাকরি করে।
খুবই অবাক কান্ড। রমেনের বয়স কত হল বলো তো।
আমার সমান। তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন।
বুঝলাম। কিন্তু তোমার উদ্বেগের কী আছে?
আছে। অলোক রমেন ভট্টাচার্যকে চেনে, ভাবসাবও আছে। ভাবছি, আমাদের কথা আবার বলে দেয়নি তো।
রমেন এমনিতে চাপা স্বভাবের মানুষ। তবে বলা যায় না।
আজ অলোক খুব ধরেছিল রাখীর ঘটনাটা রমেনকে জানানোর জন্য।
আমি রাজি হইনি।
ঠিকই তো করেছ।
সেটা বুঝতে পারছি না। ধরো রমেন ভট্টাচার্য যদি সত্যিই রাখীর বায়োলজিকাল বাবা হত, তাহলে আমি অত স্ট্রংলি অপোজ করতে পারতাম না। অলোক হয়তো সেটাই দেখতে এসেছিল, আমি আপত্তি করি কিনা। হয়তো ও জানে যে রাখী রমেনের মেয়ে নয়। কার মেয়ে সেটাও হয়তো জানে।
ঘাবড়ে যেও না। শুধু হানচ থেকে ডিডাকশন করা ঠিক নয়। চুপচাপ থাকো।
আমার মনে হচ্ছে, আমি মনের দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছি। মেয়েটার এই ঘটনা আমাকে এত ভেঙে ফেলেছে।
রাখীর জন্য আমিও তো ভাবছি। কিন্তু মার্ডার অ্যাটেম্পট বলে তুমি শিবদাসকে ক্ষেপিয়ে তুলছ কেন?
আমার খুব মনে হচ্ছে, ওকে কেউ খুন করার চেষ্টা করেছে।
যে খুন করে সে এভাবে জটিল পথে করবে না। সে টপ করে কাজ সারবে। ছুরি মারবে, গুলি করবে বা গলা টিপে মারবে। বিষ খাওয়াতে যাওয়াটা বোকামি।
একটা কথা বলব? কিছু মনে কোরো না।
বলো। ইদানিং জানতে পেরেছি, বাবলু আর রাখী প্রেমে পড়েছে। কী ঘেন্নার কথা বলো।
উড়ো কথা আমারও কানে এসেছে।
তুমি সামলাও। নইলে কী বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে বলো তো।
রাখী ভালো হয়ে উঠলে তুমি ওকে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা কোরো।
কী বলে বোঝাব? নিজের পাপের কথা কবুল করব?
পাপ কেন হবে! পাপ বলছ কেন? রমেন ভট্টাচার্যের বাবা হওয়ার ক্ষমতা ছিল না, তাই তোমাকে অন্য পন্থায় মা হতে হয়েছে। পাপের কথা উঠছে কেন?
ওভাবে বোলো না। রমেনের বাবা হওয়ার ক্ষমতা তো পরীক্ষা করা হয়নি। তবে সে বাবা হতে চাইত না। ওই একটা ব্যাপারে তার বিরাগ ছিল। অতিরিক্ত বন্ধন সে পছন্দ করত না। এসব তো তুমি জানো।
ক্ষমতা ছিল না বলেই চাইত না। ঠিক আছে, প্রসঙ্গটা থাক। বলছি, এখন মাথা ঠিক রাখো। পরিস্থিতি জটিল করে তুললে মুশকিল হবে। অ্যাণ্ড ডোন্ট ক্রাই মার্ডার।
নইলে রাখী সুইসাইড করতে যাবে কেন বল। এমন তো কিছু ঘটেনি যাতে মরতে হবে।
এখনকার জেনারেশনকে তুমি কতটা বোঝো? তুমি শিক্ষিকা বটে, কিন্তু জেনারেশন গ্যাপ অতিক্রম করা তো সহজ নয়। রাখীর মনের খবর বা অ্যাটিচুড বা বাবলুর সঙ্গে কতটা ইনভলভমেন্ট তাও তো তুমি জানো না।
ওটা ঠিক কথা নয় বিশু। রাখীর সঙ্গে আমি বন্ধুর মতোই মিশি।
আমাদের মধ্যে খোলামেলা কথা হয়। ও আমাকে সব বলে।
তাহলে বাবলুর কথা বলেনি কেন?
হয়তো সময়মতো ঠিকই বলত।
মৃন্ময়ী, মায়েরা ওরকমই ভেবে নেয় ছেলে-মেয়েদের। আর এটাই ভুল করে।
তুমি কি রাখীকে দেখতে গিয়েছিলে?
না। ইন ফ্যাক্ট, অফিস থেকে বেরিয়ে নার্সিং হোম হয়ে বাড়ি ফিরব বলে বেরোতে। যাচ্ছিলাম, ঠিক এ সময়ে তোমার ফোন এল।
রাখী মাঝে মাঝে আমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করে।
কী কথা?
জিজ্ঞেস করে কার সঙ্গে ওর মুখের আদল বেশি মেলে। মা না বাবা।
তুমি কী জবাব দাও?
কী বলার আছে বলো। যার সঙ্গে ওর মুখের আদলের আশ্চর্য মিল তার কথা তো ওকে বলতে পারি না।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশ্বদেব বলে, সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ মৃন্ময়ী। কখনো কি মিলটা রাখী খুঁজে পাবে? মাস ছয়েক আগে একটা মেয়ের বার্থ সার্টিফিকেটের জন্য এসেছিল আমার কাছে। খুব যেন অবাক চোখে বারবার দেখছিল আমার মুখ। একটু অস্বস্তি হয়েছিল আমার।
বলোনি তো।
মনের ভুলও হতে পারে। মনে পাপ আছে বলেই হয়তো অস্বস্তি হচ্ছিল।
মৃন্ময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কী জানি কী হবে। যাও, একবারটি মেয়েটাকে দেখে এসো।
যাচ্ছি মৃন্ময়ী। চিন্তা কোরো না। ওর চিকিৎসার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। দরকার হলে কলকাতা থেকে স্পেশালিস্ট আনব। রাখীকে বাঁচতেই হবে।
৫. ভিজিটিং আওয়ার্স
ভিজিটিং আওয়ার্স কেটে গেছে। রিসেপশনের বেশির ভাগ আলোই নেভানো। একটিমাত্র মেয়ে রিসেপশন সামলাচ্ছে। তার সামনে শিবদাস দাঁড়ানো, সঙ্গে আরও দু-জন উর্দিধারী লোক।
শিবদাস যে। কী ব্যাপার?
আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।
আসুন, আমার ঘরে আসুন।
নার্সিং হোমে নিজের সুন্দর করে সাজানো অফিসে নিয়ে গিয়ে শিবদাসকে বসিয়ে নিজের রিভলভিং চেয়ারে গিয়ে বসে বিশ্বদেব।
বলুন।
আজ একটা গুরুতর কথা বলতে আসা।
বলুন না।
রিগার্ডিং বাবলু।
বাবলুকে নিয়ে আবার কী হল?
আপনি কি জানেন যে বাবলু ওয়াজ ইন লাভ উইথ রাখী?
ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বিশ্বদেব বলে, হ্যাঁ, এরকম একটা উড়ো খবর শুনেছি।