- বইয়ের নামঃ ধূসর সময়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. রাতের খাওয়ার টেবিলে
এ-বাড়িতে রাতের খাওয়ার টেবিলের জমায়েতটাই সবচেয়ে উপভোগ্য ব্যাপার। বিশ্বদেব এবং তার স্ত্রী, তাদের দুই ছেলে নভোজিৎ এবং চন্দ্রজিৎ, এক বউমা শর্মিলা, এক মেয়ে স্বস্তি, সবাই জড়ো হয় এ সময়ে। টেবিলটা এত বড়ো নয় বলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে না। দুই ছেলেকে নিয়ে বিশ্বদেব বসে, আর কখনো কখনো ছেলেদের চাপাচাপিতে তাদের মা-ও। শর্মিলা আর স্বস্তি প্রায়ই দেরিতে একসঙ্গে খায়। দু-জনে খুব ভাব। আপাতত তারা পরিবেশন তদারকি করছে। প্রকাশ তেওয়ারি এ-বাড়ির রান্নার লোক, ফর্সা, মধ্যবয়সী সুদর্শন পুরুষ। সে বিশ্বদেবের অফিসেও হেড বেয়ারার চাকরি করে। এ-বাড়িতে রান্নার বিনিময়ে সে মাসে হাজার টাকা, খোরাক এবং গ্যারেজের ওপরে মেজেনাইন ফ্লোরে থাকার জায়গা পেয়েছে। বিশ্বদেবের বড় মেয়ে শ্রাবন্তীর বিয়ে হয়ে গেছে। সে দিল্লিতে থাকে। নভোজিৎ অত্যন্ত কৃতবিদ্য ডাক্তার। সে এফ.আর.সি.এস. এবং এই শহরে তার জন্যই বিশ্বদেব একটা বড়ো এবং অত্যাধুনিক নার্সিং হোম খুলেছে। এত ভালো নার্সিং হোম আশেপাশে কোনো শহরেই নেই। চন্দ্রজিৎও ডাক্তার, সবে পাশ করে এখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন। টার্ম শেষ হলে বিদেশে যাওয়ার প্ল্যান আঁটছে। সে কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছে।
বিশ্বদেবের অবস্থা ভালো, মূলত কন্ট্রাক্টরির কারবার ছিল, সিভিল কনস্ট্রাকশন থেকে সে কাঠের ব্যবসা শুরু করে। তারপরে একটি টিকপ্লাই তৈরির কারখানাও। সে এই মফস্সল শহরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান।
রোজই রাতের এই খাওয়ার টেবিলে একটি গরম আড্ডা হয়।
বিশ্বদেব খেতে খেতে হঠাৎ বলল, টুলু, আজ তোকে একটু অফ-মুড বলে মনে হচ্ছে কেন রে?
টুলু নভোজিতের ডাকনাম। সে একটু হেসে বলল, প্রফেশনাল হ্যাজার্ড।
তার মানে? কোথাও সিরিয়াস রুগি নাকি?
একরকম তাই। তবে রোগ নয়, একটা মেয়ে বিষ খেয়েছে। পাম্প করে বের করা হয়েছে বটে, কিন্তু খানিকটা রক্তে মিশে গেছে। কোমাটিক কণ্ডিশন।
বয়স কত?
উনিশ-কুড়ি।
লাভ অ্যাফেয়ার, নাকি ডাওরি ফল আউট।
মেয়েটা কুমারী।
ব্যর্থ প্রেম, পরীক্ষায় ফেল বা ডিপ্রেশন।
না, তাও নয়। মেয়েটাকে তুমি হয়তো চিনবে।
কে বল তো।
হেডমিস্ট্রেস মৃন্ময়ী ভট্টাচার্যের মেয়ে রাখী।
বিশ্বদেব থমকে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, রাখী?
হ্যাঁ, স্পিরিডেট মেয়ে। ভালো গান গায়, চমৎকার ডিবেটার। তার ওপর ভালো ছাত্রী। দেখতেও খারাপ নয়। আজ সন্ধ্যেবেলা নার্সিং হোমে ভরতি করা হয়েছে। জ্ঞান নেই।
বিশ্বদেব স্থিরদৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে ছিল। খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, অবস্থা কেমন? বাঁচবে?
বোঝা যাচ্ছে না। রাতের দিকে ডায়ালিসিস করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাকে রাতে যেতে হতে পারে।
আগে ডায়ালিসিস করা হল না কেন?
ডাক্তার বৈদ্য আর সেনশর্মা দেখছেন। অ্যান্টিডোট পুশ করা হয়েছে। রি-অ্যাক্ট করলে খুব একটা ভয় নেই। টকসিনটাও ডিটেকটেড হয়েছে।
কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। মৃন্ময়ী দিদিমণি বলেছেন, অ্যাটেমপটেড মার্ডার।
বিশ্বদেব অবাক হয়ে প্রতিধ্বনি করল, মার্ডার।
বিশ্বদেবের স্ত্রী রুচিরা মন দিয়ে শুনছিল, এবার বলল, রাখীকে খুন করতে চাইবে কে? একটু ঠোঁটকাটা আর দেমাগি আছে বটে, কিন্তু এমনিতে তো ভীষণ ভালো মেয়ে।
স্বস্তি চুপ করে ছিল। হঠাৎ বলল, আমি কিন্তু জানতাম।
রুচিরা বলল, কী জানতিস?
রাখীর এরকম একটা কিছু হবে।
কী করে জানলি?
চকোলেট ক্লাবের হাবুকে তো ও-ই ধরিয়ে দিয়েছিল। ওর ভীষণ সাহস। গতবার পুজোর ফাংশানে অষ্টবসু নামে যে বাংলা ব্যাণ্ডটা গাইতে এসেছিল তাদের তিনজন মাতাল অবস্থায় স্টেজে উঠেছিল বলে ওই তো প্রথম দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি শুরু করে। তারপর কী গন্ডগোল! পুজো কমিটি পারলে রাখীকে খুন করে ফেলত।
শর্মিলা বলল, কাল যাব তো মেয়েটাকে দেখতে নার্সিং হোমে। শুনেই মনে হচ্ছে খুব ইন্টারেস্টিং মেয়ে।
চন্দ্রজিৎ ওরফে বাবলু একটু কম কথার মানুষ। এতক্ষণ এই প্রসঙ্গে একটাও কথা বলেনি। শর্মিলা তার দিকে চেয়ে হঠাৎ বলল, আচ্ছা বাবলু এত চুপচাপ কেন আজকে? এই বাবলু, কী হয়েছে তোমার?
বাবলু মুখ তুলে একটু হাসল, বলল, কিছু না।
শরীর ঠিক আছে তো?
আরে হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।
বাবলু উঠে বেসিনে হাত ধুতে গেল।
রুচিরা হঠাৎ চাপা গলায় বলল, ও-ই তো মাথাটা খেয়েছে।
বিশ্বদেব একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে চেয়ে বলল, কে কার মাথা খেয়েছে?
সে আর তোমার শুনে কাজ নেই।
নভোজিৎ তার বাবার দিকে চেয়ে বলল, এ-ব্যাপারে পুলিশ কিন্তু খুব ক্যালাস। তেমন একটা ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে না। শিবদাসবাবুকে তোমার কেমন পুলিশ অফিসার বলে মনে হয়?
কেন, শিবদাস তো বেশ এফিসিয়েন্ট..
রাখীর ব্যাপারে কিন্তু তেমন কোথাও খোঁজখবর করল না। আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করল, পয়জনিংয়ের কেস নার্সিং হোমে ভরতি করলেন কেন? হাসপাতালে পাঠানোই তো উচিত ছিল। আর জিজ্ঞেস করল, সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে কিনা।
সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে?
তা জানি না। রাখীকে তো পাওয়া গেছে ওদের বাড়ির চিলেকোঠায়। সুইসাইড নোট থাকলে সেখানেই থাকবে। ওকে যখন নার্সিং হোমে আনা হয় তখন পরনে একটা হাউসকোট ছিল। তার পকেটে কিছু পাওয়া যায়নি।