পারুল দেখল। কোন কোনও মহিলা আছে যাদের রূপ যেন পুরুষের দিকে তেড়ে আসে। সব কিছুই যেন বড় বেশি উগ্র। অমলের বউকে সুন্দরী বলতেই হবে। তবে সেটা বড় উচ্চগ্রামে বাঁধা। অতি ফর্সা, নাক অতি টিকোলো, চোখ অতি টানা, ঠোঁটে নিষ্ঠুর ক্ষীণতা। শরীরটা কাঠ-কাঠ। মেয়েলি ভাব একটু যেন কম। আর বয়সটাও একটু বেশি, অমলের কাছাকাছি।
বেশ সুন্দরীই তো রে।
আহা, ওকে সুন্দর বলে নাকি?
মেমসাহেব-মেমসাহেব দেখতে।
স্বভাবও মেমসাহেবদের মতোই। এঁটোকাঁটা মানে না, বাঁ হাতে জল খায়।
মুখটায় একটু টেনশন আছে।
বলেছি না, দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে। মুখে মেচেতা আছে, দেখেছিস?
ছেলেটা এদিকে পিছু ফিরে ছিল। একবার মুখ ঘোরাতেই বোঝা গেল, ছেলের মুখ তার মায়ের মতো।
মেয়েটা কোথায় গেল?
হাঁটাহাঁটি করতে গেছে বোধহয়। দিনরাত তো তিনজনে ঘরবন্দি হয়ে থাকে।
তোদের সঙ্গে কথা বলে না?
না। শুধু বড়দার সঙ্গে। তাও কাজের কথা। এটা ওটা আনতে ফরমাশ করে।
সরু সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় মেয়েটার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। মেয়েটা দু-তিন সিঁড়ি উঠে এসেছিল, তাদের পাশ দেওয়ার জন্য নেমে দাঁড়াল। সিঁড়ির মাথায় টিমটিমে ডুমের আলোয় মেয়েটাকে দেখল পারুল। ফুটফুটে সুন্দর ডল পুতুলের মতো মেয়ে। মায়ের মতো কাঠ-কাঠ ভাব নেই শরীরে। একেবারেই মেয়েলি মেয়ে। মুখে হয়তোবা অমলের আদল আছে। তবে অমল সুপুরুষ ছিল না। মুখে বাপের আদল থাকলেও মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর।
মেয়েটা তাকে দেখছিল। একটু অবাক হয়েই দেখছিল। উঠোনের ওপাশে সন্ধ্যার ঘরের দরজায় উঠে ফিরে দেখল পারুল, মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে।
সন্ধ্যার ঘরে আরও প্রায় আধঘণ্টা বসে কথা কইল পারুল। সবই পুরনো কথা, ছেলেবেলার কথা।
যে মেয়ে দুটো বসে কাজ করছিল তারা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ লাজুক মুখে সন্ধ্যা বলল, দেখ পারুলদি, তোকে একটা কথা বলব?
বল না। কী কথা রে?
একটা ছেলে–হি হি–একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে।
পারুল অবাক হল না। এরকম তো হতেই পারে। বলল, কে রে?
তুমি চিনবে না। যারা আমার জিনিস নিয়ে দোকানে দোকানে সাপ্লাই করে তাদেরই একজন। বামুনের ছেলে।
প্রেমে পড়েছে নাকি? তুই পড়লি, না ও পড়ল?
দুর! সেসব নয়। আসলে আমাদের ওসব করার সময় নেই, প্রেম আবার কীসের? ও বলে বিয়ে করলে ব্যবসাটা বাড়ানো সহজ হবে। দুজনে মিলে একটা পার্টনারশিপের মতো হয় তা হলে।
পারুল একটু ভেবে বলল, খারাপ কী? মহিমকাকাকে বলেছিস?
না। কেউ জানে না। আমরা তো আর ঢলাঢলি করি না। তোমাকেই প্রথম বললুম।
তোর এখন কিছু টাকা হয়েছে সন্ধ্যা, আর সেইটেই ভয়। টাকার লোভে যদি বিয়ে করতে চেয়ে থাকে তা হলে সাবধান হওয়া ভাল।
আমিও অনেক ভাবছি। হিসেব-নিকেশ করছি। বাড়ির লোকেই বা কী ভাববে বল! আমি তাই এখনও মত দিইনি।
খুব ঝোলাঝুলি করছে নাকি?
না না, সেসব নয়। অত আঠা নেই আমাদের। শুধু বলেছে বিয়ে করলে পরস্পরকে বিশ্বাস করতে সুবিধে হবে।
তোকে কিন্তু খুশি-খুশি দেখাচ্ছে।
মা কালীর দিব্যি, খুশি-টুশি নয় রে, বরং ভয়ে বুক শুকিয়ে আছে। নেড়া আবার বেলতলায় যাওয়ার আগে একটু ভয় পাবে না, বল?
ছেলেটা যদি ভাল হয় তবে বিয়ে করে ফেল সন্ধ্যা। নইলে যখন বয়স হবে তখন দেখবি এককাঁড়ি টাকা ছাড়া আর তোর কিছু নেই।
কিন্তু কী জানিস পারুলদি, ওই লোকটার জন্য আমার আজও একটু কেমনধারা মায়া আছে। বাজে লোক, খুব পাজি লোক, তবু কেমন যেন মনে হয়, বিয়ে করলে একটা বুঝি পাপ-টাপ কিছু হবে। এটা বোধহয় কুসংস্কার, না রে?
পারুল মাথা নেড়ে বলে, আমার তা মনে হয় না। কুসংস্কার কেন হবে! লোকটা পাজি হোক, শয়তান হোক, তুই হয়তো তবু ভালবেসেছিলি। তুই তো বোকা। আর বোকারাই অন্ধের মতো ভালবাসতে পারে। চালাকরা পিছল প্রাণী।
তাই ভাবছি।
তা হলে আরও ভাবতে থাক। যা করবি ভেবে করিস।
আমার কথা তুইও একটু ভাবিস পারুলদি। ভেবে একটা বুদ্ধি দিস। আমার একদম বুদ্ধি নেই।
ভাবতে ভাবতে অন্ধকার উঠোনটা পার হচ্ছিল পারুল। অমল রায়ের বউকে দেখার জন্য এত কৌতূহল কেন তার? এতদিন বাদে সে কি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিল ওকে? ওই জায়গাটা তারই বাঁধা ছিল বলে তার কি আজও একটু দুঃখ আছে? না তো! নিজের মনকে সে খুব ভাল চেনে না বটে, কিন্তু এতদিনের বিবাহিত জীবনে অমল রায়ের জন্য তার কোনও দুঃখবোধ ছিল না তো! পড়তি বয়সে তাহলে এসব কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? অমল তো তার নাকচ করা পুরুষ।
এক তুমুল বর্ষার রাতে ভিতরে চেপে রাখা গোপন কথার কীটদংশন সইতে না পেরে সে তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশকে সবই বলে দিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সব প্রকাশ না করলে জ্যোতিপ্রকাশের সঙ্গে তার জীবনটা সম্পূর্ণ হবে না। খাদ থেকে যাবে। ভারমুক্ত হতে পারবে না সে।
শান্ত মানুষ জ্যোতিপ্রকাশ মন দিয়ে সব শুনল। তারপর বলল, শরীরের তো পাপ নেই, পাপ মনে। মনে যদি শিকড়বাকড় না থাকে তবে আর ভয় কী?
না, আমার মনে কোনও দুর্বলতা নেই।
তাহলে সব ঠিক আছে পারুল। মেয়েদের মনে একাধিক পুরুষের ছাপ থাকলে তার সন্তান অস্থিরমতি হয়।
কী করে জানলে?
জানি। যে মেয়ের মন একমুখী, কোনও কারণে তার দেহ অশুচি হলেও খুব ক্ষতি হয় না। তার সন্তান ভালই হওয়ার কথা।