তুই আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছিস। একটুও মোটা হসনি। পারুলদি, তুই যে কেন মেজদাকে বিয়ে করলি না! তা হলে আজ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতুম।
কেন রে? অমলদার বউকে কি তোর পছন্দ নয়?
এতক্ষণ সন্ধ্যার মুখে যে নির্লিপ্ত, হাসিখুশি, আলগা ভাবটা ছিল সেটা তীব্র ভ্রূকুটিতে মুখোশের মতো খসে পড়ে গেল। চাপা গলায় বলল, পছন্দ! ওরকম একটা বিচ্ছিরি স্বভাবের মেয়েমানুষকে আবার পছন্দ!
পারুল অবাক হয়ে বলে, কেন, কী করলেন উনি? ঝগড়া নাকি?
সে করলেও ভাল ছিল। ঝগড়ায় অনেক সময়ে সম্পর্ক পরিষ্কার হয়ে যায়। এ তো সে রকম নয়। মনের ভিতরে চক্কর। এ-বাড়ির কাউকে মানুষ বলেই মনে করে না। কিন্তু খুব মিষ্টি করে হেসে আর হাবেভাবে সেটা বুঝিয়ে দেবে, গলা তুলবে না, চেঁচাবে না।
তাই বুঝি?
এখন খুব মনে হয়, তোর সঙ্গে যদি মেজদার বিয়ে হত কী ভাল হত তবে। হ্যাঁ রে পারুলদি, তুই নাকি ভাল ইংরিজি বলতে পারিস?
পারুল হেসে বলে, পারব না কেন? আমার বরের পাল্লায় পড়ে শিখতে হয়েছে। কত অবাঙালি বা সাহেবসুবোকে নিয়ে ডিল করতে হয়, না শিখে উপায় আছে!
ওদের একটু ইংরিজি শুনিয়ে দিয়ে আয় না!
পারুল অবাক হয়ে বলে, ইংরিজি শোনাব কী রে? কেন?
ওরা বুঝুক গাঁয়ের মেয়েরাও ইংরিজি বলতে পারে।
পারুল হেসে বলে, তাতে কী লাভ হবে বল তো! ওরা খুব ইংরিজি বলে নাকি?
দিনরাত মায়েতে আর ছেলেমেয়েতে কেবল ইংরিজিতে কথা হচ্ছে। আমাদের নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। ঠিক বুঝতে পারি না, হাবেভাবে টের পাই। চল না পারুলদি, গিয়ে মুখের ওপর ইংরিজি বলে আসবি।
পারুল স্মিত মুখে বলে, সেটা ঠিক হবে না। ওদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, পরিচয় করার ইচ্ছেও নেই। আর ইংরিজি বলাটাও কোনও ক্রেডিট নয়। কিন্তু তুই ওদের ওপর রেগে আছিস কেন?
সন্ধ্যার মুখে আবার একটা শান্ত বিষণ্ণতা দেখা দিল। বলল, দেখ পারুলদি, তুই তো আমার কত প্রশংসা করলি। কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে নিজেকে নিয়ে লজ্জায় মরে থাকি। দেখতে কালো কুচ্ছিত, স্বামী নেয় না, তার ওপর তেমন লেখাপড়াটাও হয়নি। অমল রায়ের মায়ের পেটের বোন বলে কি আমাকে চেনা যায় বল? তার ওপর দিনরাত কামিনের মতো খাটি, তাতেই ওরা বোধহয় আমাকে লেবার ক্লাসের লোক বলে মনে করে। ছেলেমেয়ে দুটো কখনও আমাকে পিসি বলে ডাকে না। দ্যাট উওম্যান বলে কী সব যেন নিজেদের মধ্যে বলে। তাই ভাবি, তুই মেজদাকে বিয়ে করলে কত ভাল হত। কেন হলি না রে পারুলদি? মেজদার কোনও দোষ ছিল?
দোষ কার মধ্যে নেই? ওসব কথা থাক।
তুই মেজদার কথা আর ভাবিস না, না রে?
ও মা! ভাবব না কেন? সকলের কথাই ভাবি।
তোদের মধ্যে কত ভালবাসা ছিল।
পারুল একটু হেসে বলল, আজকাল ভালবাসা কথাটা শুনলেই আমার যে কী বিচ্ছিরি লাগে। টি ভি খুললেই ভালবাসা, বই খুললেই ভালবাসা, সিনেমায় গেলেই ভালবাসা। যত ভালবাসার বাদ্যি বাজছে তত ভালবাসা জিনিসটাই উবে যাচ্ছে।
তা হলে তোদের মধ্যে কী ছিল?
যা ছিল তা ওই সিনেমা টিভি উপন্যাসের মতোই, বিজ্ঞাপনের মতো ব্যাপার। আসলে ছিল কি না পরীক্ষাই হয়নি। আর ও বয়সটাও তো বুঝবার মতো বয়স নয়।
কী জানি বাবা, সেই ছেলেবেলা থেকেই তো জেনে এসেছি তুই আমার মেজো বউদি হবি। কিন্তু শেষ অবধি হল একটা–
পারুল হাসছিল। বলল, থামলি কেন?
একটা খারাপ কথা মুখে আসছিল, সেটা আটকালুম।
ভাল করেছিস। হ্যাঁ রে, অমলদার বউকে আড়াল থেকে একবার দেখিয়ে দিস তো!
আড়াল থেকে কেন? আলাপ করলেই তো হয়।
না, আলাপ করব না।
কেন রে?
আমার কেন যেন ইচ্ছে করছে না। শুধু দেখলেই হবে।
সন্ধ্যা মৃদু হেসে বলে, তোর কিন্তু এখনও একটু হিংসে আছে। ভয় নেই, সে তোর কড়ে আঙুলের নখেরও যুগ্যি নয়। দেখবি? আয় তবে। এখন ওরা নিজেদের ঘরে বসে কথা কইছে। ঝগড়াই হয় বেশির ভাগ।
ঝগড়া?
হ্যাঁ, মা আর মেয়েতে।
কী নিয়ে ঝগড়া?
সে কি আর বুঝতে পারি? ইংরিজিতে ঝগড়া। সন্দেহ হয় মেয়েটা কোনও কেলেঙ্কারি করে এসেছে। নইলে এ সময়ে হঠাৎ গাঁয়ে এসে বসে আছে কেন? পুজোর ছুটিও শুরু হয়নি, স্কুল কলেজ সব খোলা।
মেয়েটার বয়স কত?
ষোলো সতেরো তো হবেই।
পারুল একটু আনমনা হয়ে গেল। তারও তখন সতেরো বছর বয়স। মেয়েদের যৌবন মানেই চার দিকে পুরুষদের মধ্যে গুনগুন করে বার্তা পৌঁছে গেল, মেয়েটা সোমত্ত হল, ডাগর হল হে। কামগন্ধ উড়ল বাতাসে। আপনা মাসে হরিণা বৈরী। এই বয়সেই বাঘে খেয়েছিল তাকে। প্রেমিকের মতো নয়, লুঠেরার মতো তার কুসুম ছিন্ন করেছিল অমল। কিন্তু তাদের আমল আর নেই। এখন যৌবনের কেলেঙ্কারিকে অত কি আমল দেয় মা বাপেরা? যুগ কত পালটে গেছে। তার ওপর এরা বিদেশেও ছিল, যেখানে শরীর হল জলভাত।
যাবি ওপরে পারুলদি?
গিয়ে?
মেজদার বউকে দেখবি বললি যে!
ও হ্যাঁ। কিন্তু আড়াল থেকে।
হ্যাঁ, আমি তো আড়াল থেকেই দেখি। মায়ের ঘরের দরজায় একটা ফাঁক আছে। ঘরের আলো নিবিয়ে–
অমলের বউকে দেখার ইচ্ছেটা হঠাৎ কেন যেন উধাও হল পারুলের। তবু সে উঠল।
সন্ধ্যার মা মারা গেছে বছর দশেক। এ-ঘরে এখন আর কেউ থাকে না। মহিম রায় সিঁড়ি ভাঙতে অপারগ বলে আজকাল একতলায় থাকেন। দু ঘরের মাঝখানে বন্ধ দরজার ফাটলে চোখ রেখে সন্ধ্যা আগে দেখে নিল। তারপর চাপা গলায় বলল, মেয়েটা নেই। মায়ে পোয়ে বসে আছে। দেখ।